র্ভাবস্থায় ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়াকে 'প্রেগনেন্সি ব্রেইন' বা 'মমনেসিয়া' বলা হয়। এটি কোনো রোগ নয়, বরং গর্ভাবস্থায় শরীরের ভেতরের নানা পরিবর্তনের কারণে এমনটা হয়ে থাকে। আসুন আমরা এই আর্টিকেলের মাধ্যমে এ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই ।এর প্রধান কয়েকটি কারণ নিচে দেওয়া হলো:
![]() |
ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে কেন ? |
হরমোনের পরিবর্তন:
গর্ভাবস্থায় শরীর জুড়ে হরমোনের মাত্রা ব্যাপকভাবে ওঠানামা করে। বিশেষ করে ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন হরমোনের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। এই হরমোনগুলো মস্তিষ্কের কার্যকারিতায় প্রভাব ফেলে, বিশেষ করে মনে রাখার ক্ষমতা, মনোযোগ এবং তথ্যের প্রক্রিয়াকরণে কিছুটা বাধা তৈরি করতে পারে।
শারীরিক ও মানসিক চাপ:
গর্ভাবস্থায় নতুন একটি জীবন তৈরির জন্য শরীরকে অনেক বেশি কাজ করতে হয়, যা ক্লান্তি এবং মানসিক চাপ বাড়ায়। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব, বিশেষ করে রাতে বারবার বাথরুমে যাওয়া বা অস্বস্তির কারণে ঘুম ভাঙার ফলে মস্তিষ্কের বিশ্রাম হয় না। ফলে দিনের বেলায় ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়।
মস্তিষ্কের গঠনগত পরিবর্তন:
গবেষণায় দেখা গেছে যে গর্ভাবস্থায় মস্তিষ্কের কিছু অংশে গঠনগত পরিবর্তন আসে। যদিও এর সঠিক কারণ এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি, তবে ধারণা করা হয় এটি মা এবং শিশুর বন্ধনকে শক্তিশালী করার জন্য হয়। এই পরিবর্তনগুলো সাময়িকভাবে মনোযোগ এবং স্মৃতিশক্তির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
মনোযোগের পরিবর্তন:
গর্ভবতী হওয়ার পর একজন মায়ের মনযোগের কেন্দ্রবিন্দু অনেকটাই গর্ভের শিশুর দিকে চলে যায়। নতুন দায়িত্ব, আসন্ন মাতৃত্বের ভাবনা এবং শিশুর বেড়ে ওঠার নানা দিক নিয়ে ভাবতে ভাবতে স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য দৈনন্দিন বিষয়ের প্রতি মনোযোগ কিছুটা কমে যায়। এর ফলে ছোটখাটো বিষয় ভুলে যাওয়া খুব স্বাভাবিক।
ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে কেন ?
ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে, যা শারীরিক, মানসিক এবং জীবনযাত্রার ওপর নির্ভরশীল। সাধারণত, ছোটখাটো ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু যদি তা দৈনন্দিন জীবনে গুরুতর সমস্যা তৈরি করে, তবে এর পেছনে ভিন্ন কারণ থাকতে পারে।
এখানে কিছু প্রধান কারণ আলোচনা করা হলো:
১. মানসিক এবং শারীরিক ক্লান্তি
আজকালকার দ্রুতগতির জীবনে মানসিক চাপ (stress) এবং অতিরিক্ত উদ্বেগ (anxiety) খুব সাধারণ। যখন মস্তিষ্ক অতিরিক্ত চাপের মধ্যে থাকে, তখন নতুন তথ্য গ্রহণ এবং মনে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবও একটি বড় কারণ। কারণ, ঘুমের সময় মস্তিষ্ক দিনের সব তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করে স্মৃতিতে জমা রাখে। তাই অনিদ্রা বা কম ঘুম স্মৃতিশক্তির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
২. বয়সজনিত কারণ
বয়স বাড়ার সাথে সাথে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতায় কিছু স্বাভাবিক পরিবর্তন আসে। ৬৫ বছর বয়সের পর অনেকেই মাঝে মাঝে ছোটখাটো বিষয় ভুলে যান। তবে এটি যদি গুরুতর হয়, তবে তা ডিমেনশিয়া (Dementia) বা আলঝেইমার্স (Alzheimer's) রোগের লক্ষণ হতে পারে। ডিমেনশিয়া কোনো একক রোগ নয়, বরং এটি মস্তিষ্কের এমন কিছু রোগের সমষ্টি, যা স্মৃতি, চিন্তাভাবনা এবং আচরণকে প্রভাবিত করে।
৩. জীবনযাত্রার ভুল অভ্যাস
কিছু অভ্যাস স্মৃতিশক্তিকে দুর্বল করে দিতে পারে:
অ্যালকোহল ও মাদক সেবন: অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন বা মাদক গ্রহণ মস্তিষ্কের কার্যকারিতা নষ্ট করে, যার ফলে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়।
পুষ্টির অভাব: ভিটামিন বি১২-এর মতো কিছু ভিটামিন মস্তিষ্কের কার্যকারিতার জন্য অপরিহার্য। এই ধরনের ভিটামিনের ঘাটতি স্মৃতিভ্রংশ ঘটাতে পারে।
ব্যায়ামের অভাব: নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বাড়াতে সাহায্য করে, যা স্মৃতিশক্তি ভালো রাখতে জরুরি।
৪. স্বাস্থ্যগত সমস্যা
বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যা স্মৃতিশক্তির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে:
ডিপ্রেশন: দীর্ঘদিনের বিষণ্ণতা মস্তিষ্কের এমন কিছু অংশকে প্রভাবিত করে, যা স্মৃতি এবং মনোযোগের সাথে জড়িত।
থাইরয়েডের সমস্যা: থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতা কম হলে ভুলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে।
মাথায় আঘাত: গুরুতর মাথায় আঘাত বা মস্তিষ্কে সংক্রমণও স্মৃতিশক্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রয়োজনে আরো জানান-
গর্ভাবস্থায় চোখে ঝাপসা দেখার কিছু কারণ ও সমাধান
সিজারের পর ইনফেকশন কিভাবে বুঝবেন
গর্ভাবস্থায় ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়লে করণীয় কি
গর্ভাবস্থায় ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়লে বা 'প্রেগনেন্সি ব্রেইন'-এর সমস্যা দেখা দিলে কয়েকটি সহজ উপায় মেনে চললে এই সমস্যা মোকাবেলা করা যেতে পারে। এটি কোনো গুরুতর সমস্যা নয়, তাই অতিরিক্ত চিন্তিত না হয়ে নিচের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে পারেন:
১. রুটিন ও পরিকল্পনা তৈরি করুন
তালিকা তৈরি করুন: আপনার প্রতিদিনের কাজ, বাজার করার তালিকা, ডাক্তার দেখাতে যাওয়ার অ্যাপয়েন্টমেন্ট—সবকিছু একটি নোটবুক বা মোবাইলের অ্যাপে লিখে রাখুন। কাজের তালিকা তৈরি করলে কিছু ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম
অ্যালার্মসেট করুন:
মোবাইলে বা অ্যালার্ম ঘড়িতে গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপয়েন্টমেন্ট বা কাজের জন্য নোটিফিকেশন সেট করে রাখতে পারেন।
একই জায়গায় জিনিস রাখুন:
চাবি, ফোন, মানিব্যাগ—এই ধরনের জিনিসগুলো সবসময় একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রাখার অভ্যাস করুন, যাতে খোঁজাখুঁজি করতে না হয়।
২. বিশ্রাম এবং ঘুম
পর্যাপ্ত ঘুম: গর্ভাবস্থায় শরীরকে সুস্থ রাখতে পর্যাপ্ত ঘুম অত্যন্ত জরুরি। দিনে অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানোর চেষ্টা করুন। রাতের ঘুম ভালো না হলে দিনের বেলায় ছোট ছোট "পাওয়ার ন্যাপ" নিতে পারেন।
শারীরিক ও মানসিক চাপ কমান: নিয়মিত হালকা ব্যায়াম, যেমন—গর্ভাবস্থার উপযোগী যোগাসন বা হাঁটাচলা করুন। এতে মানসিক চাপ কমবে এবং মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বাড়বে। মেডিটেশন বা ডিপ ব্রিদিং এক্সারসাইজও মনকে শান্ত রাখতে সাহায্য করে।
৩. পুষ্টির দিকে মনোযোগ দিন
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড:মস্তিষ্কের কার্যকারিতার জন্য ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি মাছ, আখরোট, ফ্ল্যাক্স সিড এবং চিয়া সিডে পাওয়া যায়। তবে মাছ খাওয়ার আগে আপনার ডাক্তার বা নিউট্রিশনিস্টের সঙ্গে পরামর্শ করে নিন।
ভিটামিন ও খনিজ: ভিটামিন বি১২, ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি এবং ফলিক অ্যাসিড মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়তা করে। সবুজ শাকসবজি, ডিম, দুধ এবং তাজা ফলমূল বেশি করে খান।
পর্যাপ্ত জল পান:শরীরকে হাইড্রেটেড রাখা জরুরি। পর্যাপ্ত জল পান করলে ক্লান্তি দূর হয় এবং মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ে।
৪. মস্তিষ্ককে সচল রাখুন
মস্তিষ্কের ব্যায়াম:
নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করুন, যেমন—নতুন কোনো ভাষার কয়েকটি শব্দ, বা কোনো শখ পূরণের জন্য ছবি আঁকা বা ধাঁধা মেলানো। এটি আপনার মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলোকে সচল রাখতে সাহায্য করবে।
সামাজিক হোন:
বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলুন। এটি মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।
ধৈর্য ধরুন:
এটি গর্ভাবস্থার একটি স্বাভাবিক অংশ। মনে রাখবেন, এটি সাময়িক এবং প্রসবের পর ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। নিজেকে দোষারোপ না করে বরং এই সময়টাকে উপভোগ করুন।
মনে রাখার কিছু টিপস:
পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন: শরীরকে সুস্থ রাখতে এবং মস্তিষ্ককে সচল রাখতে পর্যাপ্ত ঘুম খুব জরুরি।
রুটিন তৈরি করুন: প্রতিদিনের কাজগুলো লিখে রাখুন। গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপয়েন্টমেন্ট বা কাজের তালিকা তৈরি করতে নোটবুক বা মোবাইলের অ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন।
মানসিক চাপ কমান: হালকা ব্যায়াম, মেডিটেশন বা পছন্দের কোনো কাজ করে মনকে শান্ত রাখার চেষ্টা করুন।
পুষ্টিকর খাবার খান: ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার (যেমন: মাছ) এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ফল ও সবজি মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে।
প্রেগনেন্সি ব্রেইন সাধারণত প্রসবের পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসে। তাই এ নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। এটি মাতৃত্বের যাত্রার একটি স্বাভাবিক অংশ।
শেষ কথা:
যদি ভুলে যাওয়ার প্রবণতা খুব বেশি হয় এবং আপনার দৈনন্দিন কাজকর্মে সমস্যা তৈরি করে, তবে আপনার গাইনেকোলজিস্টের সাথে এ বিষয়ে কথা বলতে পারেন। তিনি কোনো শারীরিক সমস্যার কারণে এমন হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করতে পারবেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবেন।