মেয়েদের অনিয়মিত মাসিকের কারণ ও করণীয়
পিরিয়ড বা মাসিক কী?
প্রত্যেক মাসে হরমোনের প্রভাবে যখন পরিণত মেয়েদের জরায়ু চক্রাকারে পরিবর্তন হতে থাকে এবং রক্ত ও জরায়ু নিঃসৃত অংশ যোনিপথ দিয়ে বের হয়ে আসে তখন তাকে পিরিয়ড বা মাসিক বলে।
মাসিক চলাকালীন সময়ে সাধারণত পেটব্যথা, পিঠব্যথা, বমি বমি ভাব হতে পারে। আর যে সমস্তনারীর এই পিরিয়ড প্রতিমাসে হয় না অথবা দুই মাস আবার কখনও চার মাস পর পর হয়, তখন তারা সাধারণত অনিয়মিত পিরিয়ড সমস্যায় ভুগে থাকেন।এবংঅনিয়মিত পিরিয়ড এর কারণে নারীদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে।
অনিয়মিত মাসিক কী ? What is irregular menstruation ?
১। মাসিক ঘনঘন হওয়া,
২।মাসিক দেরিতে হওয়া।
অনিয়মিত মাসিক বোঝার উপায়
স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ ডা. শামীমা ইয়াসমিন এর মতামত অনুযায়ী, সাধারণত২৮ দিন পরপর হয় নারীদের পিরিয়ড হয়ে থাকে। এছাড়াও পিরিয়ড যদি ২৮ দিনের ৭দিন আগে বা পরে হয়, অর্থাৎ ২১ দিন থেকে৩৫ দিন পরপর হলেও যদি সেটা নিয়মিত ব্যবধানে হয়ে থাকে, তাকেও স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেয়া হয়।
কিন্তু যদি কোন নারীর ২১ দিনের আগে বা ৩৫ দিনের পরে পিরিয়ড হয় এবং পিরিয়ড ৩ দিনের কম বা ৭দিনের বেশি স্থায়ী হলে, তখন সেই নারীর অনিয়মিত মাসিক হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
মাসিকহলে সাধারণত ২-৮ দিনপর্যন্ত স্থায়ী থাকে এবং একবার মাসিকে মোট ৫-৮০ মিলি পর্যন্ত রক্ত যেতে পারে।এবং কোন নারীর শরীরে যদি এই নিয়মের পরিবর্তন লক্ষ করা যায় তখন এই লক্ষণকে চিকিৎসকবিশেষজ্ঞরা অনিয়মিত মাসিক বলে থাকেন।
কী কারণে অনিয়মিত মাসিক হয়ে থাকে -what causes irregular menstruation ?
- পলিসিস্টিকওভারি সিন্ড্রোমের (POS) এর কারণে সাধারণতঅনিয়মিত পিরিয়ড বা একেবারেই পিরিয়ডবন্ধ হয়ে যায় ।
- অতিরিক্তশরীর চর্চা করলে
- অতিরিক্তদুশ্চিন্তা বা টেনশন করলেপিরিয়ড ঠিক মত হয় না,
- কফিজাতীয় খাবার বেশি খাওয়ার ফলে পিরিয়ডে সমস্যা দেখা যায়,
- পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন পরিবেশে বসবাস না করলে,
- মদ্যপানবা ধূমপান করলে পিরিয়ডে জটিলতা দেখা দিতে পারে।
- হঠাৎকরে যদি ওজন কমে বা বেড়ে যায়তাহলে সময়মতো পিরিয়ড না হতে পারে
- বুকেরদুধ খাওয়ানো অবস্থায় যদি হরমোনের পরিবর্তন ঘটে পিরিয়ডে সমস্যা দেখা যায়।
- বিভিন্নধরনের স্ত্রী রোগ যেমন-জরায়ুর পলিপ, ফাইব্রয়েড টিউমার, জরায়ুর প্রদাহ ও এন্ডোমেট্রোসিস রোগহলে সাধারণত পিরিয়ডের স্বাভাবিক গতিকে বাধা দিতে পারে।
- বিভিন্নধরনের ঠাণ্ডাজনিত রোগ, গলার ইনফেকশন, মনোনিউক্লিওসিস সমস্যার কারণেও পিরিয়ড দেরিতে হতে পারে।
- যারা গর্ভনিরোধক ট্যাবলেট খেয়ে থাকেন তারা অনিয়মিত মাসিক জনিত সমস্যায় ভুগতে পারেন।
পড়ুন :পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম - (PCOS) কি?
অনিয়মিত মাসিক হলে কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে?
চিকিৎসকবিশেষজ্ঞ দের মতে, আপনার পিরিয়ড যদি নিয়মের কয়েকদিন এদিক ওদিক হয়ে থাকে তাহলে সাথে সাথেই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না। কিন্তু নিম্নের সমস্যাগুলো যদি দেখা দেয় তখন আপনাকে অব্যশই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। আপনার বয়স যদি ৪৫ বছরের কমহয়ে থাকে এবং হঠাৎ করে যদি মাসিকের চক্র পরিবর্তন হয় তখন ডাক্তারেরপরামর্শ নিতে হবে। আপনার পিরিয়ড যদি ২১ দিনের আগে হয় বা ৩৫দিনের চেয়ে দীর্ঘ সময় পরে হলে। আপনার মাসিক যদি ৭ দিনের চেয়ে বেশি সময় স্থায়ী থাকে বা ৩ দিনের চেয়ে কম সময় হলে। ২০দিনের অধিক তফাৎ যদি সর্বনিম্ন মাসিক ও সর্বোচ্চ মাসিকহওয়ার মধ্যে থাকে।আপনি বাচ্চা নিতে চান কিন্তু অনিয়মিত মাসিক রয়েছে।শরীরে আয়রনের ঘাটতি হলেও অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা হতে পারে। এ সময় আয়রন বা লৌহসমৃদ্ধ খাবার খেতে দিতে হবে ।
অনিয়মিত মাসিক হলে চিকিৎসকরা কি পরামর্শ দিয়ে থাকেন?
ডা. কাজী ফয়েজা আক্তার এর মতামত অনুযায়ী, যেসব রোগীদের অনিয়মিত মাসিক রয়েছে তাদেরকে গত ৬ মাসের মাসিকের ক্যালেন্ডার রাখতে বলা হয়ে থাকে। এর ফলে কি ধরনের মাসিকের সমস্যা হয়েছে তা ঐ ক্যালেন্ডার দেখলে বোঝা যায়। এছাড়া ও রোগীর পারিবারিক কেস হিস্ট্রি, শারীরিক পরীক্ষা, কিছু রক্তপরীক্ষাসহ আলট্রাসাউন্ড করে জরায়ু ও তার আশপাশেকোন সমস্যা আছে কিনা তা নির্ণয় করাহয়।
পিরিয়ড নিয়মিত হওয়া জরুরি কেন?
নারীদের পিরিয়ড নিয়মিত না হলে তাদেরবিভিন্ন ধরনের দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য ব্যাধির ঝুঁকি থাকে এ কারণে পিরিয়ড নিয়মিত হওয়া জরুরি। পিরিয়ডের সাথে মেয়েদের পরিপাক, ঘুম, বাচ্চা হওয়া বিষয় সম্পর্কিত রয়েছে এজন্য পিরিয়ড নিয়মিত না হলে এসব দিকে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
কী কারণে কিশোরীদের অনিয়মিত মাসিক হয়ে থাকে?
কিশোরীদের অনিয়মিত মাসিক হওয়ার কারণগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো –
মেয়েদের ইসট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন নামকদুইটি হরমোন রয়েছে। ডিম্বাশয়ের অপরিপক্বতার কারণে এই হরমনের তারতম্য হয়ে থাকে এবং এসময় মাসিক যে পর্দা থেকে হয় সেই পর্দা নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা এবং ভাঙ্গতে শুরু করে।
অনিয়মিত মাসেকের ফলে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রম হয়ে থাকে। অনিয়মিত মাসিকের সাথে হাতে-পায়ে ও মুখে অবাঞ্ছিতলোম হয় এবং ঘাড়েও গলায় কালো দাগ পড়ে যায় এবং সেই সাথে ওজনও বেড়ে যায়।
কিশোরীরা মাসিকের জন্য কিভাবে তৈরি থাকবে?
যাদের অনিয়মিত মাসিক আছে তাদেরকে সাধারণত যেন অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে না হয় সেজন্য সব সময় নিজেকে তৈরি থাকতে হবে। সব সময় একটাপ্যাড এবং অতিরিক্ত একটা প্যান্টি তাদের স্কুল ব্যাগে রাখতে পারে, এর ফলে হঠাৎ পিরিয়ড হলে তাদেরকে যেন অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়তে না হয়।
অনিয়মিত মাসিক হলে কী বাচ্চা নেওয়া যাবে?
কোন নারীর যদি অনিয়মিত মাসিক হয় তাহলে তারপক্ষে বাচ্চা আসা কঠিন। এর কারণ হল অনিয়মিত মাসিক মানে তার ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু ফুটছে না। যদি ডিম না ফুটে তাহলে বাচ্চা কী করে হবে।তাই ওষুধ দিয়ে মাসিক নিয়মিত করতে হবে।তারপর বাচ্চা নিতে হবে। এরপর ও যদি বাচ্চা না আসে তাহলে ডিমফোটার ওষুধ দিতে হবে।
অনিয়মিত মাসিক হলে বাচ্চা নেওয়ার উপায়
টেস্টোস্টেরনেরমাত্রা বৃদ্ধি:
নারীদের শরীরে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমে গেলে অনিয়মিত মাসিক দেখা দেয় এবং এসময় বাচ্চা ধারনের কোন ক্ষমতাও তেমন থাকে না। এ কারণে টেস্টোস্টেরনেরমাত্রা বৃদ্ধির জন্য সুসম খাবার খেতে হবে এবং Alcohol থেকে খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
পড়ুন :
গর্ভপাত বা Miscarriage এড়াতে যে সব সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত ?
টেস্টটিউব বেবি:
আপনি যদি কোন ভাবেই সমস্যার সমাধান করতে না পারেন তখন টেস্টটিউব বেবি নিতে পারেন। টেস্টটিউব বেবি নেওয়ার জন্য দম্পতীর কাছ থেকে Eggs এবং Sperms নিয়ে Fertilise করে জরাযুতে পারফেক্টলি সেট করা হয়। এটি Science এর একটি অভিনব আবিষ্কার। স্থান ভেদে এ চিকিৎসার খরচ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে।
ঔষধ ছাড়া অনিয়মিত মাসিক প্রতিরোধের উপায় ?
নিয়মিতশরীর চর্চা করা:
নিয়মিত মাসিক না হওয়ার অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে একটি হল স্ট্রেস বা মানসিক চাপ যে সমস্ত হরমোন শরীরে পিরিয়ড নিয়ন্ত্রণ করে স্ট্রেস-এর কারণে সেগুলোর ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে যায় । এর ফলে নারীদের ঠিকমত পিরিয়ড হয় না। নিয়মিত শরীর চর্চা এবং মেডিটেশন করার ফলে স্ট্রেস দ্রুত দূর করতে সাহায্য করে।
জেনে নিন:অনিয়মিত ঋতুস্রাব( Irregular Period) নিয়মিত করার কিছু সেরা ঘরোয়া টিপস
শেষকথা:
পিরিয়ড নারীদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাধারণত প্রত্যেক নারীর মাসে একবার পিরিয়ড হয়ে থাকে। নিয়মিত পিরিয়ড হওয়া শরীরের জন্য ভালো। এর যদি ব্যতিক্রম ঘটে তবে নারীদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। অবিবাহিত নারীদের মধ্যে যাদের মাসিক অনিয়মিত হয়ে থাকে তাদের মাতৃত্বের স্বাস্থ্যঝুঁকি হতে পারে। এজন্য অনিয়মিত মাসিক হলে সময় মতো ব্যবস্থা নিতে হবে তা না হলেপরবর্তীতে বন্ধ্যত্বের ঝুঁকিও বেড়ে যেতে পারে।