সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা হারানোর পেছনে পুরুষ এবং মহিলা উভয়েরই নানা কারণ থাকতে পারে। অনেক সময় কারণগুলো জটিল হয় এবং একাধিক বিষয় এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে।
মহিলাদের সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা হারানোর কারণ
মহিলাদের ক্ষেত্রে সন্তান ধারণে অক্ষমতার প্রধান কারণগুলো হলো:
ডিম্বস্ফোটনজনিত সমস্যা: এটি মহিলাদের বন্ধ্যাত্বের অন্যতম সাধারণ কারণ। ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু নির্গত না হলে গর্ভধারণ সম্ভব হয় না। এর কয়েকটি কারণ:
উচ্চ প্রোল্যাক্টিন মাত্রা:প্রোল্যাক্টিন হরমোনের উচ্চ মাত্রা ডিম্বস্ফোটনকে বাধা দিতে পারে।
থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা:থাইরয়েড হরমোনের অতিরিক্ত বা কম উৎপাদন মাসিক চক্র ও ডিম্বস্ফোটনকে প্রভাবিত করে।
অকাল ডিম্বাশয় ব্যর্থতা (Premature Ovarian Failure): ৪০ বছর বয়সের আগেই ডিম্বাশয় কাজ করা বন্ধ করে দেয়।
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS): হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে ডিম্বাশয়ে সিস্ট তৈরি হয়, যা ডিম্বস্ফোটনে বাধা দেয়।
ফ্যালোপিয়ান টিউবের সমস্যা: ফ্যালোপিয়ান টিউব ক্ষতিগ্রস্ত বা বন্ধ থাকলে ডিম্বাণু শুক্রাণুর সঙ্গে মিলিত হতে পারে না বা জরায়ুতে পৌঁছাতে পারে না। এর কারণ হতে পারে:
সংক্রমণ: পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজ (PID) বা অন্যান্য যৌনবাহিত রোগ (যেমন গনোরিয়া) টিউবকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
এন্ডোমেট্রিওসিস: জরায়ুর ভেতরের টিস্যু জরায়ুর বাইরে বৃদ্ধি পেলে তা ফ্যালোপিয়ান টিউব এবং ডিম্বাশয়কে প্রভাবিত করতে পারে।
আগের অস্ত্রোপচার: পেটের বা পেলভিসের কোনো অস্ত্রোপচার থেকেও টিউবে সমস্যা হতে পারে।জরায়ুর সমস্যা:
ফাইব্রয়েড বা পলিপ: জরায়ুতে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ভ্রূণ প্রতিস্থাপনে বাধা দিতে পারে।
জন্মগত ত্রুটি: জরায়ুর অস্বাভাবিক গঠন।
জরায়ুর মুখের সমস্যা (Cervical disorders): সার্ভিকাল মিউকাসের সমস্যা শুক্রাণুকে জরায়ুতে প্রবেশে বাধা দিতে পারে।
বয়স: মহিলাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিম্বাণুর সংখ্যা ও গুণগত মান কমে যায়, বিশেষ করে ৩৫ বছর বয়সের পর থেকে উর্বরতা দ্রুত হ্রাস পায়।
জীবনযাপন পদ্ধতি: অতিরিক্ত ওজন বা কম ওজন, অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম, ধূমপান, মদ্যপান, মাদকের ব্যবহার এবং মানসিক চাপ উর্বরতাকে প্রভাবিত করতে পারে।
কিছু রোগ ও চিকিৎসা: দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা যেমন ডায়াবেটিস, কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশন থেরাপিও উর্বরতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
পুরুষদের সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা হারানোর কারণ
পুরুষদের ক্ষেত্রে সন্তান ধারণে অক্ষমতার প্রধান কারণগুলো হলো:
শুক্রাণুর সমস্যা: এটি পুরুষদের বন্ধ্যাত্বের সবচেয়ে সাধারণ কারণ। সমস্যাগুলো হতে পারে:
শুক্রাণুর সংখ্যা কম (Oligospermia): প্রতি মিলিলিটার বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা কম থাকলে।
শুক্রাণু একেবারেই না থাকা (Azoospermia): বীর্যে কোনো শুক্রাণু না থাকলে। এটি নালিতে বাধা বা শুক্রাণু উৎপাদনে সমস্যার কারণে হতে পারে।
শুক্রাণুর গুণগত মান খারাপ: শুক্রাণুর আকৃতি বা চলন ক্ষমতা (motility) অস্বাভাবিক হলে ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করতে পারে না।
হরমোনের ভারসাম্যহীনতা: টেস্টোস্টেরন, লুটেইনাইজিং হরমোন (LH) এবং ফলিকল-স্টিমুলেটিং হরমোন (FSH) এর মতো হরমোনের ভারসাম্যহীনতা শুক্রাণু উৎপাদন ও কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করতে পারে। পিটুইটারি গ্রন্থি বা হাইপোথ্যালামাসের সমস্যাও এর কারণ হতে পারে।
শারীরবৃত্তীয় সমস্যা:
ভ্যারিকোসিল: অণ্ডকোষের শিরা ফুলে গেলে শুক্রাণুর গুণগত মান কমে যায়। এটি পুরুষ বন্ধ্যাত্বের একটি সাধারণ কারণ।
অণ্ডকোষ নিচে না নামা (Undescended testicles): জন্মগতভাবে অণ্ডকোষ শরীরের বাইরে থলিতে না নামলে শুক্রাণু উৎপাদনে সমস্যা হয়।
শুক্রাণু পরিবহনের নালিতে বাধা: সংক্রমণ, আঘাত বা জন্মগত ত্রুটির কারণে শুক্রাণু বের হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
ইজাকুলেশন সমস্যা: রেট্রোগ্রেড ইজাকুলেশন (বীর্য মূত্রাশয়ে চলে যাওয়া) বা অকাল বীর্যপাত।
সংক্রমণ: কিছু সংক্রমণ যেমন মাম্পস, গনোরিয়া বা ক্লামাইডিয়া অণ্ডকোষ বা এপিডিডাইমিস (যেখানে শুক্রাণু পরিপক্ক হয়) কে ক্ষতিগ্রস্ত করে শুক্রাণু উৎপাদন বা স্বাস্থ্যে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
জেনেটিক ব্যাধি: ক্লাইনফেল্টার সিন্ড্রোম বা সিস্টিক ফাইব্রোসিসের মতো জেনেটিক সমস্যা পুরুষ প্রজনন অঙ্গের অস্বাভাবিক বিকাশের কারণ হতে পারে।
জীবনযাপন পদ্ধতি: ধূমপান, অতিরিক্ত মদ্যপান, মাদকের ব্যবহার, স্থূলতা, অতিরিক্ত গরম পরিবেশে কাজ করা (যেমন মধ্যপ্রাচ্যে) বা অণ্ডকোষে অতিরিক্ত তাপ লাগা (যেমন টাইট পোশাক পরা, হট টাব ব্যবহার) শুক্রাণুর গুণগত মানকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
কিছু ওষুধ ও চিকিৎসা: কিছু ওষুধ যেমন টেস্টোস্টেরন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি, অ্যানাবলিক স্টেরয়েড, কিছু আলসার বা আর্থ্রাইটিসের ওষুধ শুক্রাণু উৎপাদনে বাধা দিতে পারে। ক্যান্সার চিকিৎসা যেমন কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশন থেরাপিও উর্বরতা নষ্ট করতে পারে।
অনেক সময় স্বামী-স্ত্রী দু'জনেরই কিছু ছোটখাটো সমস্যা থাকে, যা একত্রিত হয়ে সন্তান ধারণে বাধা সৃষ্টি করে। আবার, কিছু ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না, যাকে 'অজানা বন্ধ্যাত্ব' বলা হয়।
যদি এক বছর ধরে চেষ্টা করার পরও সন্তান না আসে, তবে একজন উর্বরতা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।