আসলে ডায়াবেটিস কী?
ডায়াবেটিসহল এক ধরনের মেটাবলিক ডিজঅর্ডার। আমাদের সবার শরীরে ইনসুলিন আছে যখন এই ইনসুলিন ঠিকমতকাজ করতে না পারে অথবাযখন ইনসুলিন একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়। এরকম লক্ষণ দেখা দিলে সাধারণত চিকিৎসকরা ডায়াবেটিস হয়েছে বলে ধারণা করে থাকেন।
নারীদের ক্ষেত্রে কী ধরনের ডায়াবেটিসহয়ে থাকে?
নারীদেরক্ষেত্রে সাধারণত বিশেষ ধরনের ডায়াবেটিস হয়ে থাকে —গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বা জেসটেশনাল ডায়াবেটিস।এ ছাড়া টাইপ -১ এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও হয়ে থাকেএবং যাঁরা আগে থেকেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তাঁদের সন্তানধারণের সময় সতর্ক থাকতে হবে। কিন্তু বেশির ভাগ নারীর ক্ষেত্রেই সন্তান নেওয়ার আগপর্যন্ত শর্করা স্বাভাবিক থাকে।
এখানে আরও জানতে পারবেন...........
- ডায়াবেটিস রোগীর নরমাল ডেলিভারি কি সম্ভব ?
- গর্ভধারণের পূর্ব থেকে যদি ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত থাকেন তাহলে কী করবেন?
- গর্ভকালীনডায়াবেটিস হলে চিকিৎসক বিশেষজ্ঞরা কী পরামর্শ দিয়ে থাকেন ?
- কখন সিজারের মাধ্যমে ডেলিভারি করা হয়?
- গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকা অবস্থায় কী খাবার গ্রহণকরা উচিত ?
- সন্তানজন্মানোর পর কি ব্যবস্থাগ্রহণ করতে হবে?
- নারীদেরজন্য এই রোগটিভিন্ন মাত্রা ধারণ করেছে কেন?
চিকিৎসকেরপরামর্শ অনুযায়ী, কোন নারী যদি সন্তান নিতে চান এবং তিনি যদি আগে থেকেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত থাকেন তাহলে তাকে অবশ্যই রক্তের এইচবিএওয়ানসি নিয়ন্ত্রণে এনে, তারপর সন্তান নিতে হবে।
যাদেরগর্ভ ধারণের আগে থেকেই ডায়াবেটিস আছে এবং মুখে খাওয়ার ওষুধ খেয়ে থাকেন, তাঁদের গর্ভ ধারণ হয়েছে বোঝার সাথে সাথেই চিকিৎসক বিশেষজ্ঞরা মুখে খাওয়ার ওষুধ বন্ধ করে ইনসুলিন ব্যবহার শুরু করার পরামর্শদিয়ে থাকেন।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস কী?
কোনওনারীর যদি আগে ডায়াবেটিস নাথাকে কিন্তু গর্ভাবস্থায় রক্তে উচ্চ মাত্রার শর্করা বিকাশ লাভ করে। তখন তাকে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বলে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ফলে প্রি-এক্লাম্পসিয়া, হতাশা এবং সিজারিয়ান বিভাগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস কেন হয়?
নারীরাযখন অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় থাকে তখন তাদের শরীরে কিছু হরমোনের প্রভাবে ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা কমে যায় এর ফলে রক্তেরগ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়।এ সময় প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল থেকেউৎপন্ন হয় কর্টিসল, হিউম্যান, প্লাসেন্টাল ল্যাকটোজেন, প্রজেস্টেরন, প্রোল্যাকটিন, এস্ট্রাডিওল ইত্যাদির হরমোন দেগের রক্তের ইনসুলিনকে তার স্বাভাবিক কাজ করতে বাধা প্রদান করে ।
ফলে ইনসুলিনরক্তের গ্লুকোজকে শরীরের বিভিন্ন কোষে সঠিক পরিমাণে স্থানান্তরিত করতে বা চলাচল করতে পারে না। এর মানে হলতখন রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। এবং এসব লক্ষণ যদি গর্ভাবস্থায় প্রথমবারের দেখা যায় তখন এ ডায়াবেটিসকে চিকিৎসকবিশেষজ্ঞরা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস (জেসটেশনাল ডায়াবেটিস মেলিটাস বা জিডিএম) বলেথাকেন।
এছাড়াও গর্ভকালীনডায়াবেটিসে মা ও শিশু উভয়ই অর্থাৎ দুজনের জীবন অনেক ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। তাই এই ঝুঁকি প্রতিরোধ করার জন্য আপনার সঠিক পদক্ষেপ অর্থাৎ করতে হবে, শুধু প্রয়োজন সঠিক সময়ে ডায়াবেটিস নির্ণয় এবং এর নিয়ন্ত্রণ।
কী ভাবে বুঝবেন আপনার গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হয়েছে?
• নারীর গর্ভাধারণের পর চিকিৎসক বিশেষজ্ঞরানারীদেরকে গর্ভধারণের ২৪ থেকে ২৮সপ্তাহের মধ্যে একটি সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য পরীক্ষার পরামর্শ দেন। তারপর রক্তে শর্করা পরীক্ষা করতে হবে।
• কারণ, এই সময়টা সাধারণততাঁদের রক্তে শর্করার মাত্রা নিরূপণ করার সেরা সময় বলে চিকিৎসকরা বিবেচনা করে থাকেন।
• শুরুতে রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিক থাকলেও ২৪ সপ্তাহের পরআবার নির্ণয় করতে হবে। এই পরীক্ষার নামহল ‘ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট’।
এছাড়াওযদি নিম্নের লক্ষণ গুলো দেখা দিলে চিকিৎসক বিশেষজ্ঞরা ডায়াবেটিস হয়েছে বলে ধারণা করে থাকেন।
• বারবার পানির পিপাসা পাওয়া
• দুর্বলতা ও ক্লান্তি অনুভবকরা
• মুখের ভেতরে শুষ্ক হয়ে যাওয়া,
• চোখে ঝাপসা দেখা,
• ঘন ঘন প্রস্রাবেহওয়া
• বমি বমি ভাব অথবা বমি হওয়া। এছাড়াওক্ষুধা বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও যদি ওজন কমে যায় তাহলে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হলে চিকিৎসক বিশেষজ্ঞরা কী পরামর্শ দিয়ে থাকেন?
গর্ভকালীনসময়ে ডায়াবেটিস চিকিৎসায় মুখ দিয়ে খেতে হবে এমন কোন ওষুধ সেবন না খাওয়ায় ভালো।গর্ভকালীন ডায়াবেটিস চিকিৎসার জন্য ইনসুলিন ইনজেকশন সবচেয়ে নিরাপদ বলে চিকিৎসক বিশেষজ্ঞরা ধারণা করে থাকেন।
ঔষধ ছাড়া গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হলে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় ?
সাধারণতসবার ক্ষেত্রে কোনো ওষুধ সেবনের প্রয়োজন পড়ে না। শুধু দৈনন্দিন খাবারের অভ্যাসের পরিবর্তন এবং মাঝারি ধরনের শারীরিক ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরকে সুস্থ রাখা সম্ভব। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূল বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে সঠিকভাবে খাদ্য অভ্যাস নিয়ন্ত্রণ, পরিমিত হালকা ব্যায়াম, নির্দিষ্ট সময় অন্তর ডায়াবেটিস এর মাত্রা পরিমাণকরা, নিয়মিত স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ বা ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞেরপরামর্শ নেওয়া।
গর্ভাবস্থায়ডায়াবেটিস রোগী দের জন্য নিয়মিত ভাবে হালকা হাঁটার অভ্যাস থাকা ভালো, কিন্তু কোনো ভারী ব্যায়াম কোনো অবস্থাতেই করা যাবে না।
ডায়াবেটিস রোগীর নরমাল ডেলিভারি কি সম্ভব?
সময়মত রক্তের সুগার পরীক্ষা ও ইনসুলিনের মাত্রাপরিমাণ করতে হবে। এ ছাড়া নিয়মিতরক্ত চাপের পরিমাণ নির্ণয়, গর্ভাবস্থায় শিশুর বৃদ্ধি সঠিকভাবে হচ্ছে কি না, সেটাদেখাও গুরুত্বপূর্ণ। যদি কোনো জটিলতা না দেখা যায়তাহলে একজন গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারীর প্রসব স্বাভাবিকভাবেই হতে পারে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হলেই অস্ত্রোপচার করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। সন্তান জন্মানোর পর যত দ্রুত সম্ভবশিশুকে মায়ের বুকের দুধ খেতে দিতে হবে।
কখন সিজারের মাধ্যমে ডেলিভারি করা হয়?
যদি কোন মায়ের বেশি ওজনের বাচ্চা অথবা গর্ভস্থ ভ্রূণের বৃদ্ধি কম হয়, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, প্রি-এক্লাম্পশিয়া বা অন্য কোনোজটিল রোগ থেকে থাকে, সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরপরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে সিজারের মাধ্যমে ডেলিভারি করা লাগতে পারে। প্রসবের সময় মায়ের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অবশ্যই প্রতি লিটারে ৪.৫-৫মিলিমোল রাখতে হবে।
সন্তানজন্মানোর পর কি ব্যবস্থাগ্রহণ করতে হবে?
চিকিৎসকবিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী,
সন্তানজন্মের কিছুক্ষণের মধ্যেই শিশুর পায়ের গোড়ালি থেকে রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হবে বাচ্চার গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিক আছে কি না। যদিগ্লুকোজের মাত্রা প্রতি লিটারে ২.২ মিলিমোলেরনিচে নেমে যায়, তবে দ্রুত শিশুকে গ্লুকোজ দিতে হয়। মায়ের যদি গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকে তাহলে বাচ্চারও পরবর্তী সময়ে স্থূলকায় হওয়ার এবং টাইপ–২ ডায়াবেটিস রোগেআক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বেশিরভাগ নারীর শর্করা সন্তান প্রসবের পর স্বাভাবিক মাত্রায়ফিরে আসে। কিন্তু তার পরেও প্রসবের ছয় সপ্তাহ পরপুনরায় মায়ের রক্তে OGTT পরীক্ষা করতে হবে এবং পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিক থাকলেও প্রতিবছর কমপক্ষে একবার করে পরীক্ষা করে নেওয়া ভালো। কারণ, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হলে পরবর্তী সময়ে টাইপ–২ ডায়াবেটিসে আক্রান্তহওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকা অবস্থায় কী খাবার গ্রহণকরা উচিত?
• সাধারণত দৈনিক ৪০ শতাংশ আমিষ,
• ৪০ শতাংশ শর্করা ও
• ২০ শতাংশচর্বি জাতীয় খাবার বা ফ্যাট থাকতেপারে।
একজনপুষ্টিবিদ বা একজন ডায়াবেটিসবিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতো খাদ্য তালিকা মেনে চলতে হবে।
নারীদেরজন্য এই রোগটিভিন্ন মাত্রা ধারণ করেছে কেন?
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে প্রায় ৩৫ লাখের বেশিনারী এই ডায়াবেটিস রোগেআক্রান্ত। এবং প্রতিনিয়তই এই রোগীর সংখ্যাবেড়েই চলেছে। এবং আরো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, প্রতি২০ জন নারীর ১জন ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হয়।
চিকিৎসক বিশেষজ্ঞদের মতে এর কারণ হল,
• প্রায়ইদেখা যায় তারা বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের নিয়ে উদাসীন ও অসচেতন থাকেন, বিভিন্ন কারণে নিয়মিত ব্যায়াম বা হাঁটার অভ্যাসকরতে পারেন না,
• দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাস ঠিকমত মেনে চলে না।
• সুশৃঙ্খল জীবনাচরণ করতে পারেন না। তার মানে হল নারীদের জীবনযাত্রায়পরিবর্তনের কারণেই মূলত ডায়াবেটিস রোগ হয়ে থাকে
• সেই সাথে সাথে পরিবারের সদস্যদেরও নারীদেরপ্রতি নিয়ম মানার ক্ষেত্রে অসচেতনতা প্রহসনের কারণে এই রোগ হওয়ারসম্ভাবনা বেশি কাজকরে।
এরফলে নারীদের মধ্যে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ডায়াবেটিসরোগের প্রভাবে নারীদের প্রজননক্ষমতা, সন্তান ধারণ ও প্রসব, ব্রেস্টফিডিংসহ নানা শারীরবৃত্তীয় কাজে জটিলতা দেখা দিতে পারে।
এ রোগ থেকে নারীর মুক্তির কি উপায় রয়েছে?
চিকিৎসকবিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী সাধারণত নিম্নের বিষয় গুলো ঠিক মত মেনে চললেঅধিকাংশ নারীই এই রোগ থেকেমুক্তি পেতে পারেন।
• উদাসীনতা দূর করতে হবে। সবসময় চেষ্টা করতে হবে হাশি-খুশী থাকতে।
• পুষ্টিজাতীয় খাবারের তালিকা অনুসরণ করতে হবে
• সবুজ শাক-সবজি ও ফলমুল বেশিকরে খেতে হবে।
• লাল চাল খেতে হবে সাদা চালের পরিবর্তে, লাল আটা, ওটস ইত্যাদি খাবার খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে।
• জাঙ্ক ফুড খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তেল, ঝাল, মসলা জাতীয় খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তাহলে সুস্থ থাকতে পারবেন
• বর্তমানে ডায়াবেটিসে ছোটরাও ভুগছে এর অন্যতম কারণহল অতিরিক্ত ওজন ও মোটা হয়েযাওয়া। এ জন্য বয়সঅনুযায়ী সঠিক ওজন ধরে রাখতে হবে এবং নিয়মিত শরীর চর্চা করতে হবে।
• শরীরে ইনসুলিন ও সুগার নিয়ন্ত্রণেরাখার অন্যতম উপায় হল নিয়মিত ব্যায়ামকরা। তাই দিনে অন্তত পক্ষে ৩০ মিনিট ব্যায়ামকরতে হবে।
• নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে। আপনাকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে ওষুধ । তবে ওষুধনা খেয়েই শরীরের সুগার কমানো যেতে পারে সেজন্য জীবনযাত্রা পরিবর্তন করতে হবে।
• ডায়াবেটিস রোগীকে অবশ্যই নিয়মিত চেকআপ করতে হবে। নিয়মিত সুগার পরীক্ষা করত হবে।
পরিশেষে বলা যায় যে,
বর্তমানে এই রোগটি প্রায় মহামারির আকার ধারণ করতে চলছে। আর যাদের এই রোগ একবার হয়েছে, তা আর কখনোই সারেনা এবং বাংলাদেশ সহ সমস্ত বিশ্বজুড়েই এই রোগের প্রভাববেড়েই চলেছে। এবং গবেষণায় দেখা গেছে পুরুষের তুলনায় নারীদের ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা ও মৃত্যু ঝুঁকিবেশি। কিন্তু চিকিৎসক বিশেষজ্ঞদের মতে জীবনযাত্রার পরিবর্তন ও দৈনন্দিন খাদ্যাভাসপরিবর্তনের মাধ্যমে অনেকাংশে কমিয়ে আনা যায়। তাই প্রতেক নারীর উচিত উপরি উক্ত নির্দেশ গুলো অনুসরণ করে সুস্থ থাকা।