জেনে নিন-পানি খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা

 

পানি কখন পান করা আপনার শরীরের জন্য বেশি উপকারী এবং কখন পানি পান করলে আপনার শরীরে ক্ষতি হতে পারে ? পানি পান করার সঠিক নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন

                           পানি খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা
`

জীবনে বেঁচে থাকার জন্য পানির কোন বিকল্প নেই। পানি আমাদের শরীরের সকল ধরনের প্রয়োজনীয়তা মিটিয়ে শরীরকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। এর পাশাপাশি কিডনির মাধ্যমে শরীর থেকে ক্ষতিকর উপাদান বের করে দিবে। তাই শরীর সুস্থ রাখতে হলে অবশ্যই আমাদেরকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে। তবে নিয়ম মেনে পানি পান করা উচিত। আমাদের শরীরে যদি পানির পরিমাণ কমে যায় তাহলে শরীরে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। ঠিক তেমনি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পানি পান করলে অর্থাৎ শরীরে পানির আধিক্য হলে আবার ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু পানি পান করার সঠিক নিয়ম সম্পর্কে না জানার কারণে বেশির ভাগ মানুষই নিয়ম না মেনে পানি খায়। যার ফলে তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। সে জন্য আমাদেরকে পানি কখন পানি পান করতে হবে এবং কখন পানি পান করা যাবে না সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা থাকতে হবে।

এখন আসুন আমরা পানি খাওয়ার সঠিক নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই,

 

কখন পানি পান করা শরীরের জন্য বেশি উপকার ?

আপনার পানি পান করার উপযুক্ত সময় সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো

তৃষ্ণার্ত থাকলে  :

অনেক সময় তৃষ্ণার্ত থাকা বা পানির পিপাসা পাওয়া সত্ত্বেও নানা ব্যস্ততায় থাকার কারণে আমরা পানি পান করার প্রয়োজন অনুভব করি না। এতে করে আমাদের শরীরে পানিশূন্যতার সৃষ্টি হতে পারে এবং পরবর্তীতে এই ডিহাইড্রেশন থেকে নানা ধরনের জটিল রোগ সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।

সে জন্য যখনই আপনি তৃষ্ণার্ত থাকবেন তখনই পানি পান করে নিবেন। এতে করে আপনার শরীরে পানির চাহিদা পূরণ থাকবে। যার ফলে আপনার রোগ বালাই হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে।

 আরও পড়ুন:

যে অভ্যাস গুলোর কারণে আপনার ভুড়ি জমতে পারে ?

Piles বা অর্শ কী ? কী কারণে পাইলস হয় এবং সারানোর উপায় ?

সকালে ঘুম থেকে উঠার পরে :

সকালে ঘুম থেকে উঠার পরে খালি পেটে পানি পান করলে আপনি অনেক উপকার পেতে পারেন। সারা রাত ঘুমানোর কারণে আপনার শরীর পানিশূন্য হয়ে পড়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠে পানি খেলে আপনার পানিশূন্যতা দূর হবে এবং এর পাশাপাশি যদি আপনার গ্যাস বা অম্বলের সমস্যা থাকে সেটি দূর হয়ে যাবে। তাই সকালে ঘুম থেকে উঠার পরে আপনাকে  অবশ্যই খালি পেটে কমপক্ষে এক গ্লাস পানি পান করা উচিত। এটি আপনার শরীরের সকল অঙ্গ প্রতঙ্গ গুলো সক্রিয় করে তুলতে সাহায্য করবে।

ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করার আগে :

আপনার শরীরকে সক্রিয় রাখার জন্য ব্যায়াম করা খুবই জরুরি। কিন্তু এই ব্যায়াম করার ফলে আপনার শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে তরল জাতীয় পদার্থ ঘামের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়। এতে করে আপনার শরীরে পানির চাহিদা দেখা দিতে পারে। সে জন্য এক্সারসাইজ করার আগে অন্তত আপনাকে আধা লিটারের মত পানি পান করে নিতে হবে। আর ব্যায়াম করার ফাঁকে ফাঁকে ১০ থেকে ১৫ মিনিট পরপর আপনি এক গ্লাস করে পানি পান করে নিবেন। এতে করে আপনার দেহে পানির সমতা বজায় থাকবে।

ক্ষুধার্ত বোধ হলে :

ক্ষুধা লাগার সাথে সাথে আপনি অনেক সময় আগে পানি না খেয়ে চা, বিস্কুট, টোস্ট প্রভৃতি আজে বাজে খাবার খেয়ে থাকতে পারেন। এমন করলে অ্যাসিডিটি বা গ্যাস সমস্যা বেড়ে যেতে পারে। তাই ক্ষুধার্ত বোধ করলেই সব সময় আগে এক গ্লাস পানি পান করে নিবেন। তারপর অন্য খাবার খাবেন। আগে পানি পান করার ফলে আপনার অন্যান্য খাবার কম গ্রহণ করা হবে এবং সেই সাথে শরীরে তরলের পরিমাণ পর্যাপ্ত থাকবে।

ঘাম হওয়ার পরে :

আপনি যখন ঘামতে থাকেন তখন আপনার দেহ থেকে লোমকূপের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে তরল জাতীয় পদার্থ বাষ্পাকারে বেরিয়ে যেতে থাকে। এই বেরিয়ে যাওয়া তরলের ঘাটতি যদি আপনি ঠিক মত পূরণ না করেন তাহলে এর জন্য আপনার শরীরে পানির স্বল্পতা দেখা দিতে পারে। সে জন্য ঘামার সাথে সাথে আপনাকে বেশি বেশি করে পানি পান করে নিতে হবে। 

পিরিয়ডের সমস্যা হলে :

পিরিয়ড বা মাসিকের সমস্যা হওয়ার মূল কারণ হল পানিশূন্যতা। ডিহাইড্রেশনের কারণে আপনার অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই পিরিয়ড নিয়মিত করতে হলে আপনাকে বেশি বেশি করে পানি খেতে হবে। আর এছাড়া পিরিয়ডের সময় আপনার দেহে অস্বস্তি ভাব যেমন : ক্র্যাম্প বা মাথাব্যথা, পেটে ব্যথা, পেট ফাঁপা প্রভৃতি দেখা দিতে পারে। নিয়মিত পর্যাপ্ত পানি পান করলে পিরিয়ডের আগের এই অস্বস্তি ভাব গুলো কাটাতে  আপনার তেমন কোন কষ্ট হবে না।

আপনার যদি ডিসমেনোরিয়া অথবা অত্যন্ত বেদনাদায়ক মাসিকের সমস্যায় ভোগেন তাহলে আপনাকে বেশি পানি পান করার ফলে আপনি এই পেলভিক ব্যথা থেকে মুক্তি লাভ করতে পারেন।

খাবার খাওয়ার আগে :

শরীর সুস্থ রাখতে হলে আপনাকে সব সময় খাবার খাওয়ার আগে পানি খেয়ে নিতে হবে। এই নিয়মে পানি খেলে এটি আপনার শরীর সুস্থ থাকার পাশাপাশি আপনার দেহে যদি মেদ জমা থাকে তাহলে সেই সমস্যা দূর করতে সহায়তা করবে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, যাদের খাবারের আধা ঘণ্টা আগে আধা লিটার করে পানি পান করার অভ্যাস আছে তারা ১২ সপ্তাহে পাউন্ডের বেশি ওজন কমাতে পারবে।

তাই আপনি যদি ওজন কমাতে চান তাহলে খাবার খাওয়ার অন্তত আধা ঘণ্টা আগে হাফ লিটার করে পানি খেয়ে নিবেন। এরপর খাবার খাবেন।

ক্লান্তি অনুভব করলে :

অনেক সময় আমরা দুপুরে খাবার খাওয়ার পর, বিকালের দিকে কিংবা সারা দিনের খাটা খাটনির পর রাতের খাবারের পরে দূর্বলতা বা ক্লান্তি অনুভব করে থাকি। এই ক্লান্তি দূর করতে অনেকেই চা, কফি খেয়ে থাকেন। কিন্তু এতে আপনার শরীর কড়া হয়ে যেতে পারে। তাই ক্লান্তি অনুভব হলে আপনি এই সব খাওয়ার পরিবর্তে এক গ্লাস পানি খেতে পারেন। এতে করে আপনার শরীরে সৃষ্টি হওয়া দূর্বলতা কাটিয়ে উঠে অ্যানার্জি লেভেল আরও বেশি বৃদ্ধি পাবে। শরীরে তরলের সমতা ঠিক থাকলে আর্দ্রতা বজায় থাকবে এবং মন স্মৃতিশক্তি ভালো থাকবে।

গোসল করার আগে :

গোসল করার আগে পানি পান করা উত্তম। এতে করে আপনার দেহে হাইড্রোলজিকাল ব্যালান্স বজায় থাকবে। তাই গোসলে যাওয়ার আগে আপনি এক গ্লাস পানি পান করতে পারেন। এর ফলে আপনার উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকলে সেটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসবে, এমনটি চিকিৎসক বিশেষজ্ঞরা বলছেন।

মাইগ্রেনের সমস্যা থাকলে :

মাইগ্রেন হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হল ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা। আপনি যদি মাইগ্রেনের সমস্যায় ভোগেন তাহলে আপনাকে অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে। এতে করে আপনি মাইগ্রেনের সমস্যা থেকে সহজেই মুক্তি লাভ করতে পারেন।

অসুস্থ বোধ করলে :

আপনি যদি আগে থেকে কোন অসুখে ভুগেন অথবা হঠাৎ করে যদি অসুস্থ বোধ করেন তাহলে অবশ্যই আপনাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে। তাহলে আপনি এই অসুস্থতা থেকে দ্রুত আরোগ্য লাভ করতে পারবেন।

এছাড়া ক্যাফেইন অ্যালকোহল জাতীয় দ্রব্য থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। কারণ এই সব দ্রব্যাদি গ্রহণ করার ফলে আপনার শরীর আরও বেশি পানিশূন্য হয়ে যেতে পারে। যার ফলে আপনার বডিতে বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যেতে পারে।

 

কখন পানি পান করা শরীরের জন্য ক্ষতি হতে পারে ?

পানি পান করার অনুপযুক্ত সময় সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো

দাঁড়িয়ে পানি খেলে :

দাঁড়িয়ে পানি পান করার অভ্যাস একেবারেই ভাল নয়। আপনি যদি দাঁড়িয়ে পানি খান তাহলে আপনার স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। এছাড়াও আপনার কিডনির ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে যার ফলে আপনাকে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মোকাবেলা করতে হতে পারে।সে জন্য সব সময় বসে পানি পান করার চেষ্টা করবেন।

তৃষ্ণা না পেলে :

অনেক সময় তৃষ্ণা না পেলে আমরা পানি পান করে থাকি। শরীরের প্রয়োজন তুলনায় যদি আপনি বেশি পানি পান করেন তাহলে আপনার দেহে লবণের সমতা নষ্ট হয়ে যাবে। যার ফলে আপনার শরীরে বিভিন্ন ধরনের রোগ ব্যধি দেখা দিতে পারে।

তাই সুস্থ থাকতে হলে তৃষ্ণা না পেলে কখনোই আপনি পানি খাবেন না।

খাবার খাওয়ার সময়ে পানি খেলে :

খাবার খাওয়ার ভিতরে কখনই বেশি পানি পান করা যাবে না।অনেক সময় অন্য মনস্ক থাকলে আপনার বিষম লাগতে পারে। অথবা খাবার খাদ্যনালীতে না গিয়ে শ্বাস নালীতে চলে যেতে পারে। যার ফলে আপনার মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।তাই খাবারের সময় অল্প করে পানি খেতে হবে এবং চেষ্টা করতে হবে সব সময় খাবার খাওয়ার আধা ঘন্টা আগে খেতে হবে।

প্রস্রাবের বর্ণ পরিষ্কার হলে :

প্রস্রাবের বর্ণ যদি হলুদ না থাকে অর্থাৎ আপনার যদি প্রস্রাব পরিষ্কার হয় তাহলে আপনার শরীরে পানির পরিমাণ ঠিক আছে। কিন্তু আপনার দেহে পর্যাপ্ত পানি থাকার পরেও যদি আপনি পান করেন তাহলে হিতের বিপরীত ঘটতে পারে।

তাড়া হুড়া করে পানি খেলে :

তাড়াহুড়া করে পানি খেলে আপনার বিষম লাগা সহ বিভিন্ন ধরনের জটিল সমস্যা দেখা দিতে পারে। সে জন্য কখনই তাড়াহুড়া করে পানি পান করবেন না।

খাবার খাওয়ার পরপর পানি খেলে :

খাবার খাওয়ার পরপর পানি পান করা উচিত নয়। খাবারের পরপর যদি আপনি পানি খান তাহলে আপনার বদহজম থেকে শুরু করে পেটে গ্যাস হওয়া, ঢেকুর ওঠার আশঙ্কা প্রভৃতি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।

এই সব ক্ষতি এড়াতে হলে আপনাকে খাবার শেষ করার পর অন্তত ৩০ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। তারপর পানি পান করতে হবে।

ঠান্ডা পানি পান করলে :

ঠান্ডা পানি বেশি পান করলে এটি আপনার দেহের ভিতরের স্বাভাবিক তাপমাত্রার সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না। যার ফলে আপনার ঠান্ডা জনিত রোগ যেমন : জ্বর, সর্দি, কাশি প্রভৃতি দেখা দিতে পারে। 

তাই আপনাকে বরফ ঠাণ্ডা পানি পান যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে এবং এর পরিবর্তে স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি পান করতে হবে।

ব্যায়াম করার পরপর পানি খেলে :

ব্যায়াম করা শেষ হওয়ার সাথে সাথে পানি খাওয়া একেবারে উচিত নয়। এতে আপনার হার্টের ক্ষতি হতে পারে। জন্য ব্যায়াম শেষ হওয়ার পরে সব সময় হালকা রেস্ট নিয়ে তারপর পানি খাবেন।

আরও পড়ুন:

হার্ট অ্যাটাক কি ? হার্ট অ্যাটাক কেন হয়? প্রতিকার কিভাবে করবেন?

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,

সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে হলে পানি অপরিহার্য। তবে নিজেকে সুস্থ রাখার জন্য অবশ্যই আমাদেরকে একটি নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী পানি পান করতে হবে। তা না হলে হিতের বিপরীত হয়ে যেতে পারে। তাই পানি পান করার সময় আপনাকে সর্তক থাকতে হবে এবং উপরিউক্ত নিয়ম গুলো অনুসরণ করে তারপর পানি পান করতে হবে।

Post a Comment

Previous Next