গর্ভকালীন সময়ে একজন নারীর শরীরে বিভিন্ন ধরনের হরমোনের মাত্রা পরিবর্তিত হয়, যা শারীরিক ও মানসিক নানা পরিবর্তনের জন্য দায়ী। এই হরমোনগুলো গর্ভাবস্থা বজায় রাখা, ভ্রূণের সঠিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করা এবং প্রসবের জন্য শরীরকে প্রস্তুত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিচে প্রধান কয়েকটি হরমোন এবং তাদের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
![]() |
গর্ভকালীন সময়ে বিভিন্ন হরমোনের প্রভাব |
গর্ভকালীন সময়ে হরমোনের প্রভাব
১. হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন (hCG):
কাজ: এটি গর্ভধারণের পরপরই প্লাসেন্টা (গর্ভফুল) দ্বারা উৎপাদিত হতে শুরু করে। গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে এই হরমোনের মাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এটি ডিম্বাণুকে জরায়ুর প্রাচীরে প্রতিস্থাপিত হতে সাহায্য করে এবং প্রোজেস্টেরন হরমোন উৎপাদনে সহায়তা করে।
প্রভাব: hCG হরমোনের উচ্চ মাত্রার কারণে গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে অনেক নারীর মধ্যে বমি বমি ভাব এবং বমি (মর্নিং সিকনেস) হতে পারে। এই হরমোনই সাধারণত প্রেগনেন্সি টেস্ট কিটে ধরা পড়ে।
২. প্রোজেস্টেরন:
কাজ: এই হরমোনকে "গর্ভাবস্থা রক্ষাকারী হরমোন" বলা হয়। এটি জরায়ুর আস্তরণকে ঘন করে এবং ভ্রূণের বেড়ে ওঠার জন্য একটি উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে। প্রোজেস্টেরন জরায়ুর পেশীগুলিকে শিথিল রাখতে সাহায্য করে যাতে অকাল প্রসবের সম্ভাবনা কমে যায়।
প্রভাব: প্রোজেস্টেরনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় প্রথম ত্রৈমাসিকে ক্লান্তি, ঘুম ঘুম ভাব এবং অবসন্নতা দেখা দিতে পারে। এছাড়াও, এটি মেজাজের পরিবর্তন, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং স্তনের কোমলতা বৃদ্ধি করতে পারে।
৩. ইস্ট্রোজেন:
কাজ: ইস্ট্রোজেন হরমোন জরায়ু, স্তন এবং অন্যান্য অঙ্গের বৃদ্ধি ও বিকাশে সহায়তা করে। এটি ভ্রূণের সঠিক বিকাশের জন্যও অপরিহার্য।
প্রভাব: ইস্ট্রোজেনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় স্তন ফুলে যাওয়া বা ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এই হরমোন মেজাজের পরিবর্তন, আবেগপ্রবণতা এবং মুডি হয়ে যাওয়ার জন্যও দায়ী।
৪. রিলাক্সিন:
কাজ: এই হরমোন প্রসবের আগে পেলভিক লিগামেন্ট এবং পেশীগুলোকে শিথিল করে এবং জরায়ুকে প্রসারিত হতে সাহায্য করে, যাতে প্রসব সহজ হয়।
প্রভাব: রিলাক্সিন হরমোনের প্রভাবে শরীরের জয়েন্টগুলো শিথিল হতে পারে, যার ফলে সামান্য ব্যথা বা অস্বস্তি হতে পারে।
৫. অক্সিটোসিন:
কাজ: অক্সিটোসিনকে "ভালোবাসার হরমোন" বা "প্রসব হরমোন" বলা হয়। এটি প্রসবের সময় জরায়ুর পেশীগুলোকে সংকুচিত করতে সাহায্য করে। প্রসবের পর এটি মায়ের স্তন থেকে দুধ নিঃসরণেও ভূমিকা রাখে।
প্রভাব: প্রসবের সময় এই হরমোন জরায়ুর সংকোচন ঘটায়, যা প্রসব বেদনা শুরু করে।
৬. থাইরয়েড হরমোন:
কাজ: থাইরয়েড হরমোন মায়ের বিপাক নিয়ন্ত্রণ করে এবং শিশুর স্নায়বিক ও মস্তিষ্কের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
প্রভাব: গর্ভাবস্থায় থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা সঠিক থাকা জরুরি। যদি এই হরমোনের ঘাটতি থাকে (হাইপোথাইরয়েডিজম), তাহলে গর্ভপাত, অকাল প্রসব বা শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে সমস্যা হতে পারে।
এই হরমোনগুলোর ওঠানামার কারণে গর্ভাবস্থায় একজন নারীর শরীরে বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দেয়, যেমন - ক্লান্তি, বমি বমি ভাব, মেজাজের পরিবর্তন, স্তনে ব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং ওজন বৃদ্ধি। এই পরিবর্তনগুলো স্বাভাবিক এবং গর্ভাবস্থার একটি অপরিহার্য অংশ।