বাচ্চারা অতিরিক্ত জেদ করে করণীয় কি
বাচ্চাদের জেদি হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে। এগুলো বোঝা বাবা-মায়ের জন্য খুব জরুরি, কারণ কারণগুলো জানতে পারলে সমস্যা মোকাবিলা করা সহজ হয়। নিচে কিছু প্রধান কারণ আলোচনা করা হলো:
১. নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করতে না পারা
ছোট বাচ্চারা বড়দের মতো নিজেদের ইচ্ছা, হতাশা, রাগ বা ক্লান্তি গুছিয়ে প্রকাশ করতে পারে না। যখন তারা কোনো কিছু চায় বা কোনো কারণে মন খারাপ হয়, কিন্তু তা মুখে বলতে পারে না, তখন জেদের মাধ্যমে তাদের সেই অনুভূতি প্রকাশ করে। এটি তাদের মনের ভেতরের অস্থিরতার বাহ্যিক রূপ।
২. মনোযোগ আকর্ষণ
অনেক সময় বাচ্চারা দেখে যে জেদ করলে বা চিৎকার-চেঁচামেচি করলে তারা বাবা-মায়ের মনোযোগ পায়। বিশেষ করে, যখন বাবা-মায়েরা ব্যস্ত থাকেন বা সন্তানকে যথেষ্ট সময় দিতে পারেন না, তখন শিশুরা জেদ করে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। তাদের কাছে খারাপ মনোযোগও কোনো মনোযোগ না পাওয়ার চেয়ে ভালো মনে হতে পারে।
৩. ক্লান্তি, ক্ষুধা বা অস্বস্তি
যেমন বড়দের মেজাজ খারাপ হয় ক্লান্তি বা ক্ষুধার কারণে, তেমনি বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও এটি হয়। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে, খিদে পেলে বা কোনো শারীরিক অস্বস্তি হলে বাচ্চারা খিটখিটে হয়ে যায় এবং জেদ করতে শুরু করে।
৪. নিজেদের ক্ষমতা যাচাই করা
শিশুরা যখন বড় হতে শুরু করে, তখন তারা নিজেদের সীমা এবং ক্ষমতা যাচাই করতে চায়। তারা বুঝতে চায় যে তারা কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং তাদের ইচ্ছার ফল কী হতে পারে। এটি তাদের স্বাধীন হওয়ার প্রক্রিয়ার একটি অংশ। যেমন, তারা নিজেই জুতো পরতে চায় বা খাবার খেতে চায়, আর এতে ব্যর্থ হলে জেদ করে।
৫. সুনির্দিষ্ট সীমার অভাব
যদি বাচ্চাদের জন্য কোনো স্পষ্ট নিয়ম বা সীমা না থাকে, তাহলে তারা কোথায় থামতে হবে তা বুঝতে পারে না। তারা যদি দেখে যে জেদ করলে মাঝে মাঝে তাদের ইচ্ছা পূরণ হয়, তাহলে তারা আরও বেশি জেদি হয়ে ওঠে। বাবা-মায়ের মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণের অভাবেও এটি হতে পারে।
৬. অতিরিক্ত চাপ বা উত্তেজনা
কোনো নতুন পরিবেশ, অতিরিক্ত উদ্দীপনা (যেমন, অনেক খেলনা বা বেশি কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ), বা রুটিনের পরিবর্তন বাচ্চাদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে তারা জেদ করে।
৭. অনুকরণের প্রবণতা
বাচ্চারা তাদের চারপাশের পরিবেশ থেকে শেখে। যদি তারা দেখে যে বাবা-মা বা পরিবারের অন্য সদস্যরা জেদ করে বা চিৎকার করে নিজেদের দাবি আদায় করে, তাহলে তারাও সেই আচরণ অনুকরণ করতে শুরু করে।
৮. "টেরিবল টুজ" বা বিকাশের পর্যায়
প্রায় ১৮ মাস থেকে ৩-৪ বছর বয়স পর্যন্ত বাচ্চাদের মধ্যে "টেরিবল টুজ" নামে একটি পর্যায় দেখা যায়। এই সময়টায় বাচ্চারা নিজেদের ব্যক্তিত্ব তৈরি করতে শুরু করে এবং সবকিছুতে 'না' বলা বা জেদ করা তাদের জন্য খুব সাধারণ। এটি তাদের বিকাশের একটি স্বাভাবিক অংশ।
৯. চাহিদা পূরণ না হওয়া
বাচ্চারা যখন তাদের কোনো নির্দিষ্ট চাহিদা পূরণ করতে পারে না বা তাদের প্রত্যাশা পূরণ হয় না, তখন তারা হতাশ হয়ে পড়ে এবং জেদ করে। যেমন, কোনো খেলনা না পাওয়া বা পছন্দের খাবার না পাওয়া।
এই কারণগুলো বোঝার মাধ্যমে বাবা-মায়েরা তাদের জেদি সন্তানের প্রতি আরও সহানুভূতিশীল হতে পারবেন এবং কার্যকরভাবে তাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।
বাচ্চারা অতিরিক্ত জেদ করলে বাবা-মায়ের করণীয়
বাচ্চারা জেদ করলে বাবা-মায়ের জন্য পরিস্থিতি সামলানো বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। তবে কিছু কৌশল অবলম্বন করলে এই সমস্যা মোকাবিলা করা সহজ হতে পারে। নিচে কিছু টিপস দেওয়া হলো:
১. শান্ত থাকুন
বাচ্চা জেদ করলে বাবা-মায়ের আগে নিজেকে শান্ত রাখতে হবে। আপনি উত্তেজিত হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। গভীর শ্বাস নিন এবং মনে রাখবেন এটা বাচ্চাদের স্বাভাবিক আচরণ।
২. কারণ বোঝার চেষ্টা করুন
বাচ্চা কেন জেদ করছে তা বোঝার চেষ্টা করুন। হতে পারে সে ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত, বিরক্ত বা কোনো কিছু চেয়ে পাচ্ছে না। কারণ বুঝতে পারলে সমাধান করা সহজ হবে।
৩. মনোযোগ সরিয়ে দিন
অনেক সময় বাচ্চাদের জেদ ভাঙানোর জন্য তাদের মনোযোগ অন্য দিকে সরিয়ে দেওয়া ভালো কাজ করে। যে জিনিসটা নিয়ে জেদ করছে, সেখান থেকে তার মনোযোগ অন্য কোনো মজার জিনিসে বা কাজে নিয়ে যান। যেমন, "চলো, আমরা এখন একটা গল্প পড়ি" বা "বাইরে হাঁটতে যাবে?"
৪. বিকল্প প্রস্তাব দিন
যদি বাচ্চা কোনো নির্দিষ্ট খেলনা বা খাবার নিয়ে জেদ করে, তাহলে তাকে সরাসরি 'না' না বলে অন্য কোনো বিকল্প প্রস্তাব দিন। যেমন, "এই খেলনাটা এখন নেই, তুমি কি অন্য খেলনা দিয়ে খেলবে?" বা "এই খাবারটা এখন নেই, তুমি কি অন্য খাবার খাবে?"
৫. সীমা নির্ধারণ করুন
বাচ্চাদের জন্য সুস্পষ্ট সীমা নির্ধারণ করা জরুরি। কিছু জিনিস তারা পাবে না, এটা তাদের বুঝতে শেখাতে হবে। যখন তারা জেদ করবে, তখন শান্তভাবে আপনার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিন এবং সেই সিদ্ধান্তে অটল থাকুন।
৬. ইতিবাচক আচরণে উৎসাহ দিন
যখন বাচ্চা জেদ করবে না বা ভালো ব্যবহার করবে, তখন তাকে প্রশংসা করুন এবং উৎসাহ দিন। এতে তারা বুঝবে যে ভালো আচরণ করলে প্রশংসা পাওয়া যায়।
৭. ধৈর্য ধরুন
বাচ্চাদের জেদ কমানো এক দিনে সম্ভব নয়। এর জন্য ধৈর্য এবং ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। প্রতিটি জেদের পরিস্থিতিতে একই রকমভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানোর চেষ্টা করুন।
৮. শারীরিক শাস্তি এড়িয়ে চলুন
বাচ্চাদের জেদের জন্য শারীরিক শাস্তি দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। এটি তাদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং জেদ আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। বরং তাদের বুঝিয়ে বলুন।
৯. পর্যাপ্ত ঘুম ও পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করুন
অনেক সময় পর্যাপ্ত ঘুম না হলে বা পুষ্টিকর খাবার না খেলে বাচ্চারা খিটখিটে হয়ে যায় এবং জেদ করে। তাদের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম এবং স্বাস্থ্যকর খাবারের ব্যবস্থা করুন।