মানসিক রোগ কি ? মানসিক রোগ থেকে মুক্তির সেরা উপায়

 মানসিক রোগ থেকে মুক্তি পেতে কি করবেন ? সম্পর্কে  বিস্তারিত জেনে নিন-

মানসিক রোগ কি ? মানসিক রোগ  থেকে মুক্তির সেরা উপায়

কথায় আছে, মন ভাল তো সব ভালো। আমাদের শারীরিক সুস্থ থাকার পিছনে মন একটা বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। আপনার মন যদি ভালো থাকে তাহলে স্বাভাবিক ভাবে আপনার শরীর ভালো থাকবে। কিন্তু আমরা দিনের বেশির ভাগ সময়ই শরীরের যত্ন নেওয়ার উপর ব্যায় করি কিন্তু মনের যত্ন নেওয়ার পেছনে তেমন কোন সময় ব্যায় করি না। তবে আমরা সবাই কম বেশি মানসিক রোগে ভুগে থাকি কিন্তু এই অসুখ সম্পর্কে ঠিক মত ধারণা না থাকার কারণে আমরা অনেকেই এই অসুখ ধরতে পারি না কিংবা এই অসুখ হয়েছে সেটা বুঝতে পারলে সেটাকে তেমন গুরুত্বের সাথে দেখি না। যার জন্য পরবর্তীতে এই রোগ ধীরে ধীরে প্রবল হয়ে আমাদেরকে মানসিক ভারসাম্যহীন পর্যন্ত করে দিতে পারে। সে জন্য আমাদেরকে মানসিক রোগ হওয়ার কারণ এবং এর থেকে মুক্তির উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা থাকা খুবই জরুরি। 

এখন চলুন আমরা মানসিক রোগ সম্পর্কিত বিষয় গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই,

মানসিক রোগ বা Mental Disorder কী ?

মানসিক রোগ কে অনেক সময় আমরা মনোরোগ বলে থাকি। এটা হল এক ধরনের মনের রোগ যা মূলত মস্তিষ্কের সমস্যার কারণে ঘটে থাকে। অর্থাৎ আপনার ব্রেনে যদি কোন প্রকার সমস্যা হয় যার জন্য আপনার দৈনন্দিন জীবনযাপন যেমন : চলা-ফেরা, আচার-আচরণ প্রভৃতিতে অস্বাভাবিকতা প্রকাশ পায় তাহলে তাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় Mental Disorder বা মানসিক রোগ বলে।

মানসিক রোগ কাদের বেশি হয়ে থাকে ?

মনোরোগ যে কোন বয়সের মানুষেরই হতে পারে। তবে সাম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে যে, বর্তমান সময়ে বয়স্ক ব্যক্তিদের তুলনায় টিনএজ বা অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েদের ভিতরে মধ্যে মেন্টাল ডিসওর্ডার - আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা অপেক্ষাকৃত বেশি।

মানসিক রোগ কয় ধরনের হয়ে থাকে ?

মনোরোগকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। সে গুলো হল

* Neurosis (মৃদু মানসিক রোগ)

* Psychosis (তীব্র মানসিক রোগ)

*Neurosis (মৃদু মানসিক রোগ) :

নিউরোসিস হলে তা সামান্য ওষুধ দ্বারা চিকিসা এবং সাইকোথেরাপির মাধ্যমে প্রতিকার করা যায় সে জন্য একে মৃদু মানসিক রোগ বলা হয়। নিউরোসিস রোগের মধ্যে রয়েছে টেনশন, হিস্টিরিয়া, ফোবিয়া, দুশ্চিন্তা, অবসেশন, হিস্টিরিয়া প্রভৃতি। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের নিউরোটিক বলা হয় নিউরোটিক ব্যক্তির আচার আচরণ, তার পরিবার এবং সমাজের জন্য তেমন ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। তবে এই রোগ একবার হলে বারবার হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে এবং মানুষের মধ্যে এই রোগে আক্রান্তের হার অনেক বেশি থাকে।

Psychosis (তীব্র মানসিক রোগ) :

সাইকোসিস হল এক ধরনের জটিল বা তীব্র মানসিক রোগ। সাইকোসিস রোগের মধ্যে রয়েছে সিজোফ্রেনিয়া বিষণ্নতা বিষণ্নতা। নিউরোসিস রোগের তুলনায় সাইকোসিস রোগে অনেক কম সংখ্যক লোক ভুগে থাকেন। আর এই রোগ একবার হয়ে সেরে গেলে তা পুনরায় ফিরে আসার প্রবণতা নিউরোসিস এর তুলনায় অনেক কম এবং এই রোগে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা সেবার প্রয়োজন হয়।

 কী কী কারণে মানসিক রোগ হতে পারে ?

যে সমস্যা কারণে আপনার মানসিক রোগ হতে পারে সে সমস্যাগুলো সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো

জিনগত বা বংশগত কারণে :

আপনার পরিবারের অন্য কোন সদস্য বাবা-মা, ভাই-বোন যদি আগে থেকে মানসিক রোগে আক্রান্ত থাকেন তাহলে তাদের কাছ থেকে আপনার শরীরে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।

ব্রেনের স্ট্রাকচার জনিত সমস্যা :

জন্মের সময় বা কোন বড় ধরনের এক্সিডেন্টে যদি আপনার মস্তিষ্ক বা ব্রেনের গঠনে কোন  প্রকার সমস্যা থাকে তাহলে আপনার  মনোরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি বেড়ে যাবে।

অতিরিক্ত মানসিক চাপ :

আপনি যদি দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত টেনশন বা মানসিক চাপের ভেতরে থাকেন তাহলে তাহলে এই চাপের কারণে ব্রেনের ব্যাপক ক্ষতি হবে। আর ব্রেনের ক্ষতি হলে স্বাভাবিক ভাবে আপনার মেন্টাল ডিসওর্ডার হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি বেড়ে যাবে।  

দীর্ঘদিন ধরে অনিদ্রায় ভুগা :

দীর্ঘদিন ধরে যদি আপনি ঘুমের সমস্যায় ভুগেন  তাহলে এটি আপনার মানসিক চাপকে বাড়িয়ে দিয়ে মস্তিষ্কের উপর চাপ সৃষ্টি করবে। যার থেকে পরবর্তীতে আপনার মানসিক রোগ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। 

ছোটবেলা থেকে সঠিক গাইডলাইনের অভাব :

ছোটবেলা থেকে যদি আপনাকে সঠিকভাবে গাইডলাইনের মধ্যে না রাখা হয় অর্থাৎ লালন-পালন যদি ঠিক মত না হয় তাহলে বড় হয়ে আপনার কার্যকর্মে অস্বাভাবিকতা ফুটে উঠবে। যার ফলে আপনি আরও বেশি ঘাবড়ে গিয়ে এটি আপনার ব্রেনকে আঘাত করবে। যার ফলে আপনার মনোরোগ হতে পারে। 

নেশা জাতীয় দ্রব্যের প্রতি আসক্ত হওয়া :

ধুমপান, মাদক দ্রব্য ইত্যাদি নেশা জাতীয় দ্রব্যের প্রতি আপনি যদি তীব্র আসক্ত হন তাহলে এগুলো শরীরের ভিতরে প্রবেশ করে আপনার মস্তিষ্কের কোষগুলোকে ব্যাপক ভাবে উত্তেজিত করে তোলে যা আপনার মেন্টাল ডিসওর্ডার হওয়ার প্রবণতাকে অনেকাংশেই বাড়িয়ে দিবে।

শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার হলে :

আপনি যদি শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার হন তাহলে এটি আপনার মানসিক চাপকে অতিরিক্ত বাড়িয়ে দিবে। যার ফলে আপনার মনোরোগ হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।

জটিল রোগে ভুগলে :

দীর্ঘদিন ধরে যদি আপনি বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগ যেমন : ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট ফেইলওর,  কিডনি লিভারে সমস্যা প্রভৃতিতে ভোগেন এবং এর জন্য নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন তাহলে এসব ওষুধের সাইড ইফেক্ট আপনার মস্তিষ্ককে ব্যাপক ভাবে এফেক্ট করে। যা আপনার মেন্টাল ডিসওর্ডার হওয়ার প্রবণতাকে বাড়িয়ে দিতে পারে। 

যে সব উপসর্গ দেখা দিলে বুঝবেন মানসিক রোগে আক্রান্ত ?

কিছু নির্দিষ্ট উপসর্গ দেখা দিলে আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন আপনার মানসিক রোগ হয়েছে কিনা। উপসর্গগুলো সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো

একাকীত্বকে বেছে নেওয়া  :

মানসিক রোগ হলে আপনার একাকী থাকতে ইচ্ছা করবে অর্থাৎ সে সময় আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কারও সাথে কথা বলতে ভাল লাগবে না। বরং এড়িয়ে চলে যেতে মনে হবে।

মেজাজ খিটখিটে থাকা :

মনোরোগে ভুগলে আপনার মস্তিষ্ক সব সময় উত্তেজিত থাকবে যা আপনার মনের উপর প্রভাব ফলবে। সে জন্য কেউ কোন কথা বলে আপনার তা শুনতে ইচ্ছা করবে না। আর তখনই আপনার মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাবে। আর আপনি হুটহাট করে ঝগড়া করে ফেলবেন।

হতাশা বা বিষন্নতায় ভুগা :

আপনি যদি দীর্ঘদিন ধরে মেন্টাল ডিসওর্ডারে ভুগেন তাহলে এটি এক সময় আপনার মনে  হতাশা বা বিষন্নতায় জন্ম দিতে পারে।

ঘুমের অভাব বা অনিদ্রা :

এই রোগ হলে চোখ থেকে ঘুম উঠে যাবে। অর্থাৎ সময় আপনি অনিদ্রায় ভুগবেন বা এই রোগ আপনার  ঘুমের পরিমাণকে অনেক কমিয়ে দিবে।

আগের ভাল লাগা কর্মকান্ডের প্রতি অনাগ্রহ প্রকাশ করা :

মনোরোগ হলে আপনার পূর্বে যে সকল কাজ গুলো করতে ভালো লাগতো সে সকল কাজ গুলোর প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়ার কারণে তা আর করতে ভাল লাগবে না।

কোন কারণ ছাড়াই অন্যদেরকে সন্দেহ করা :

মেন্টাল ডিসওর্ডারে ভুগার কারণে আপনি সবাইকে অযথা সন্দেহ করতে থাকবেন। অর্থাৎ সময় আপনার কারও উপর বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করবে না। সব সময় মনে হবে যে সবাই আপনার ক্ষতি করতে চায়।

সামাজিকীকরণ করা থেকে নিজেকে দূরে রাখা :

এই রোগ হলে আপনার সামাজিকীকরণ করতে বা কারও সাথে মেলা-মেশা করতে ইচ্ছা করবে না। অর্থাৎ সময় আপনি যথাসম্ভব নিজেকে বাইরের জগত থেকে দূরে রাখতে চাইবেন।

ক্ষুধা কমে যাওয়া :

মেন্টাল ডিসওর্ডার হলে ঠিক মত কিছু খেতে ইচ্ছা হবে না। কারণ সময় আপনার খাবারের উপর থেকে রুচি উঠে যাবে।

শারিরীক যত্ন না নেওয়া :

মনোরোগের কারণে আপনার নিয়মিত কাজ যেমন : গোসল করা, দাত ব্রাশ প্রভৃতি করতে ইচ্ছা করবে না।

কাজের প্রতি অনীহা :

এই রোগ হলে আপনার দৈনন্দিন পেশাগত কাজের উপর অনীহা তৈরী হবে অর্থাৎ কাজে ঠিক মত মন বসবে না এবং নিজেকে উদাসীন মনে হবে।

মানসিক রোগ থেকে মুক্তির পেতে কি করবেন ?

মানসিক রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার কিছু সহজ উপায় রয়েছে। উপায়গুলো সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো

নিয়মিত ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করা :

নিয়মিত ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করার ফলে এটি আপনার শরীর থেকে সারাদিনের গ্লানি ক্লান্তি দূর করে আপনার মনকে প্রফুল্ল রাখতে সহায়তা করবে। আর মন ঠিক থাকলে মানসিক রোগ হওয়ার চান্স কম থাকবে।

প্রয়োজনে আরো পড়ুন:

নিয়মিত ব্যায়াম করুন ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন

হার্ট অ্যাটাক কি ? হার্ট অ্যাটাক কেন হয়? হার্ট অ্যাটাক থেকে বাচার উপায়

 নিদ্রাহীনতা আপনার শরীরে মারাত্নক প্রভাব ফেলতে পারে 

পর্যাপ্ত ঘুম বিশ্রাম নেয়া :

মেন্টাল ডিসওর্ডার হওয়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে হলে অব্যশই নিয়মিত বিশ্রাম ঘুম ঠিক রাখুন। এতে করে আপনার সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে এবং শরীর মন দুটোই ভাল থাকবে।

রুটিনমাফিক জীবন-যাপন করা :

নিজের দৈনন্দিন কার্যক্রমের একটি রুটিন বানিয়ে ফেলুন। আর চেষ্টা করুন রুটিন মেনে কাজ করার। তাহলে দেখবেন কাজ তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে এবং কাজের সময় নিয়ে এক্সট্রা প্রেসারে থাকতে হচ্ছে না। এতে করে আপনার টেনশন কম হবে। যার ফলে আপনি মনোরোগ হওয়ার হাত থেকে রেহাই পাবেন।

ধর্মীয় কাজে মন দেয়া :

ধর্মীয় কাজে মনোবেনিবেশ করা একটা উত্তম ইবাদত। এটা আমাদের মানসিক হতাশা দূর করার পাশাপাশি মানসিক প্রশান্তি দিবে। তাই মেন্টাল ডিসওর্ডার দূর করতে হলে ধর্মীয় কাজে মনোনিবেশ করতে পারেন।

বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়স্বজনদের সাথে মেলামেশা করা :

আপনি যদি নিজেকে মানসিক রোগ বাঁচাতে চান তাহলে একাকীত্বতা দূর করতে হবে।  বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়স্বজনদের সাথে সব সময় ওপেন মাইন্ড থাকার চেষ্টা করবেন। আপনার দুঃখ,হতাশা, দূর্দশা কারণ গুলো তাদের সাথে শেয়ার করুন। তাহলে আপনি মানসিক দিক দিয়ে প্রেসার মুক্ত থাকবেন।

নেশা জাতীয় দ্রব্য নিজেকে দূরে রাখা :

মনোরোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে সব সময় নিজেকে বিভিন্ন ধরনের নেশা জাতীয় দ্রব্য যেমন : মদ, সিগারেট, গাজা প্রভৃতি সেবন করা থেকে দূরে রাখবেন। 

কাজে ব্যস্ত থাকা :

মেন্টাল ডিসওর্ডার হওয়া রোধ করতে হলে কখনও একঘেয়েমি ভাব নিয়ে বসে থাকবেন না। কারণ এতে মানসিক চাপ বাড়ে। সব সময় কাজে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করুন।

স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়া :

মনোরোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে খাদ্য তালিকায় স্বাস্থ্যসম্মত খাবার যেমন : মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, সবুজ শাক-সবজী প্রভৃতি রাখুন। এসব খাবার আপনার শরীর ভাল রাখার পাশাপাশি মনকে ফুরফুরে রাখবে।

আরও পড়ুন :

গর্ভধারণে মানসিক চাপ যেসব প্রভাব ফেলতে পারে

আমাদের মন্তব্য:

মানসিক রোগের প্রভাব যদি একজন মানুষের শরীরে তীব্র হয়ে যায় তাহলে এটি এক সময় ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই আমাদেরকে বিষয়টিকে হেলা-ফেলা না করে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে। প্রয়োজনে একজন অভিজ্ঞ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিবেন।  আর সব সময় শরীরের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি মনের যত্ন নিবেন। কারণ মন ভাল থাকলেই শরীর ভাল থাকবে। আর মানসিক রোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে উপরিউক্ত বিষয় গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখবেন। 

 

Post a Comment

Previous Next