হিট স্ট্রোক কেন হয় ?
হিট স্ট্রোক একটি মারাত্মক অবস্থা যা শরীরে অতিরিক্ত তাপের কারণে ঘটে। যখন শরীর তার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তখন হিট স্ট্রোক হতে পারে। এর প্রধান কারণগুলো হলো:
- উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা: গরম আবহাওয়ায় দীর্ঘ সময় ধরে থাকলে এবং বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকলে শরীরের ঘাম শুকিয়ে যেতে পারে না, ফলে শরীর ঠান্ডা হতে পারে না।
- অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম: গরম আবহাওয়ায় অতিরিক্ত শারীরিক কাজ বা ব্যায়াম করলে শরীর প্রচুর তাপ উৎপন্ন করে যা শরীর ঠান্ডা করার ক্ষমতার বাইরে চলে যেতে পারে।
- অপর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান: ডিহাইড্রেশন বা শরীরে জলের অভাব হলে ঘাম তৈরি কমে যায়, যা শরীরকে ঠান্ডা রাখতে বাধা দেয়।
- পোশাক: আঁটসাঁট বা গাঢ় রঙের পোশাক পরিধান করলে শরীরের তাপ বাইরে বের হতে বাধা পায়।
- কিছু ঔষধ: কিছু ঔষধ যেমন ডাইইউরেটিক্স, বিটা-ব্লকার, এবং মানসিক রোগের ঔষধ শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে।
- কিছু স্বাস্থ্যগত অবস্থা: স্থূলতা, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী রোগ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- মদ্যপান: অ্যালকোহল ডিহাইড্রেশন করতে পারে এবং শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে বাধা দিতে পারে।
- বয়স: বয়স্ক ব্যক্তি এবং শিশুরা তাপমাত্রার পরিবর্তনের সাথে সহজে মানিয়ে নিতে পারে না, তাই তারা হিট স্ট্রোকের ঝুঁকিতে বেশি থাকে।
- গাড়িতে আটকে থাকা: বদ্ধ গাড়িতে তাপমাত্রা খুব দ্রুত বাড়তে পারে, যা হিট স্ট্রোকের কারণ হতে পারে।
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয়
পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করা:
দিনের বেলায় প্রচুর পরিমাণে জল পান করুন। যখনই বাইরে যাবেন, জলের বোতল সঙ্গে রাখুন। তৃষ্ণা না পেলেও অল্প অল্প করে জল পান করতে থাকুন। লবণাক্ত বা মিষ্টি পানীয়ের চেয়ে সাধারণ জল পান করা বেশি ভালো। যারা শারীরিক পরিশ্রম করেন বা ব্যায়াম করেন, তাদের আরও বেশি জল পান করা উচিত।
হালকা ও আরামদায়ক পোশাক পরিধান করা:
গরমের সময় হালকা রঙের, ঢিলেঢালা এবং সহজে বাতাস চলাচল করতে পারে এমন পোশাক পরিধান করুন। সিনথেটিক কাপড়ের চেয়ে সুতির কাপড় আরামদায়ক হবে।
গরমের সময় সরাসরি রোদ এড়িয়ে চলা:
দিনের বেলায় যখন রোদের তেজ বেশি থাকে (সাধারণত সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা), তখন সরাসরি রোদ এড়িয়ে চলুন। প্রয়োজনে ছাতা, টুপি বা ক্যাপ ব্যবহার করুন।
শারীরিক কার্যকলাপ সীমিত করা:
গরমের সময় অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করা উচিত না। যদি করতেই হয়, তাহলে দিনের ঠান্ডা অংশে (সকাল অথবা সন্ধ্যা) করুন এবং মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিন।
ঠান্ডা পানিতে গোসল বা শরীর ঠান্ডা রাখা:
দিনের বেলায় একাধিকবার ঠান্ডা পানিতে গোসল করুন অথবা ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর ও মুখ মুছুন। এতে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
যানবাহনের ভেতরে সতর্কতা:
বদ্ধ গাড়ির ভেতরে তাপমাত্রা খুব দ্রুত বাড়তে পারে। তাই পার্ক করা গাড়িতে শিশু বা পোষা প্রাণীকে একা ফেলে রাখবেন না।
অ্যালকোহল ও ক্যাফেইন পরিহার করা:
অ্যালকোহল এবং ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় শরীরকে ডিহাইড্রেটেড করতে পারে। তাই গরমের সময় এগুলো পরিহার করাই ভালো।
খাবারের দিকে খেয়াল রাখা:
হালকা ও সহজে হজমযোগ্য খাবার খান। তেল মসলাযুক্ত খাবার পরিহার করুন। তরমুজ, শসা, লেবু জাতীয় ফল এবং সবজি বেশি করে খান, কারণ এগুলোতে জলের পরিমাণ বেশি থাকে।
কিছু ঔষধের ক্ষেত্রে সতর্কতা:
যারা বিশেষ কোনো স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন বা কিছু নির্দিষ্ট ঔষধ (যেমন ডাইইউরেটিক্স, বিটা-ব্লকার) গ্রহণ করছেন, তারা হিট স্ট্রোকের ঝুঁকিতে বেশি থাকেন। তাই এই সময়ে তাদের বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত এবং প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
কর্মক্ষেত্রে সতর্কতা:
যারা বাইরে কাজ করেন, তাদের কাজের সময় বিশ্রাম নেওয়ার এবং পর্যাপ্ত জল পান করার সুযোগ রাখা উচিত। নিয়োগকর্তাদের উচিত কর্মীদের জন্য ঠান্ডা পানীয় এবং ছায়ার ব্যবস্থা করা।
শিশুদের ও বয়স্কদের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখা:
শিশু এবং বয়স্ক ব্যক্তিরা হিট স্ট্রোকের ঝুঁকিতে বেশি থাকে। তাদের প্রতি বিশেষ নজর রাখুন এবং তারা যেন পর্যাপ্ত জল পান করে ও রোদে কম যায় তা নিশ্চিত করুন।
হিট স্ট্রোক হলে বোঝার উপায়
হিট স্ট্রোক হয়েছে কিনা, তা বোঝার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ ও উপসর্গ রয়েছে। এই লক্ষণগুলো দেখা গেলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা উচিত:
গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ:
- শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি: শরীরের তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) বা তার বেশি হতে পারে।
- মানসিক অবস্থার পরিবর্তন: বিভ্রান্তি, অস্থিরতা, বিরক্তি, প্রলাপ বকা, অসংলগ্ন কথা বলা, এমনকি খিঁচুনি বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
- ত্বকের পরিবর্তন: ত্বক গরম, শুষ্ক ও লালচে হয়ে যেতে পারে। তবে কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে পরিশ্রমজনিত হিট স্ট্রোকে ত্বক ঘামযুক্তও হতে পারে।
- দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস: শ্বাস নেওয়ার গতি বেড়ে যাওয়া এবং অগভীর শ্বাস নেওয়া।
- দ্রুত হৃদস্পন্দন: নাড়ির গতি খুব দ্রুত হতে পারে।
- তীব্র মাথাব্যথা: অসহ্য যন্ত্রণা হতে পারে।
- বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া: অস্বস্তি এবং বমি হতে পারে।
অন্যান্য লক্ষণ:
- পেশিতে দুর্বলতা বা খিঁচুনি: মাংসপেশিতে ব্যথা বা টান লাগতে পারে।
- প্রচণ্ড তৃষ্ণা: খুব বেশি জল তেষ্টা পাওয়া।
- মূত্রের পরিমাণ কমে যাওয়া এবং গাঢ় হলুদ রঙের হওয়া: শরীরে জলের অভাবের কারণে এমন হতে পারে।
- মাথা ঘোরা বা ঝিমুনি: দুর্বল লাগা এবং ভারসাম্য হারাতে পারে।
হিট স্ট্রোক হলে যা করণীয়
হিট স্ট্রোক হলে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে যা করণীয়:
- রোগীকে দ্রুত ঠান্ডা স্থানে সরিয়ে নিয়ে যান: তাকে ছায়াযুক্ত বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) কোনো স্থানে নিয়ে যান।
- পোশাক ঢিলা করুন: গায়ের জামাকাপড় খুলে দিন বা ঢিলা করে দিন, যাতে বাতাস চলাচল করতে পারে।
- শরীর ঠান্ডা করুন:
- ঠান্ডা পানি দিয়ে শরীর স্পঞ্জ করুন বা ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছুন। বিশেষ করে বগল, ঘাড় ও কুঁচকির নিচে ঠান্ডা পানি দিন।
- সম্ভব হলে রোগীকে ঠান্ডা পানিতে গোসল করান।
- শরীরে বরফ লাগাতে পারেন।
- রোগীর গায়ে বাতাস করুন, ফ্যান বা হাতপাখা ব্যবহার করতে পারেন।
- পানীয় দিন: যদি রোগী জ্ঞান হারানো না থাকে, তাহলে তাকে ধীরে ধীরে ঠান্ডা পানি বা লবণ-চিনির শরবত (ওরাল স্যালাইন) পান করতে দিন। চা বা কফি দেবেন না।
- চিকিৎসা সহায়তা নিন: দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স ডাকুন বা রোগীকে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যান। হিট স্ট্রোক একটি জরুরি অবস্থা এবং দ্রুত চিকিৎসা না করালে রোগীর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
- শ্বাস-প্রশ্বাস ও নাড়ি পর্যবেক্ষণ: রোগীর জ্ঞান না থাকলে তার শ্বাস-প্রশ্বাস এবং নাড়ি চলছে কিনা তা খেয়াল রাখুন। প্রয়োজন হলে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করতে হতে পারে (যদি আপনার প্রশিক্ষণ থাকে)।
- জ্বর মনে করে ওষুধ দেবেন না: হিট স্ট্রোকের কারণে শরীরের তাপমাত্রা বাড়লে জ্বর মনে করে কোনো ওষুধ দেবেন না।
হিট স্ট্রোক একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা, তবে কিছু সহজ পদক্ষেপের মাধ্যমে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। যেহেতু এখন মে মাসের মাঝামাঝি এবং বাংলাদেশে গরমের তীব্রতা বেশ বেশি, তাই হিট স্ট্রোক প্রতিরোধের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর উপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত: