রক্তের সুগার লেভেল বেড়েছে কি না কিভাবে বুঝবেন ?

আপনার রক্তের সুগার লেভেল (Blood Sugar Level) হাই কি না তা কিভাবে বুঝবেনকোন উপায় অবলম্বন করলে আপনি ব্লাড  সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন ? সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন


                       রক্তের সুগার লেভেল বেড়েছে কি না কিভাবে বুঝবেন ?

 আমাদের শরীরে রক্তে সুগারের মাত্রা বা Blood Sugar Level যদি বেড়ে যায় তাহলে আমাদের বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগ যেমন : ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, হাইপারটেনশন প্রভৃতি হতে পারে ক্রমাগত ভাবে ব্লাড সুগার লেভেলের তারতম্যের কারণে  প্রতিনিয়ত এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা আমাদের দৈনন্দিন কর্মকান্ডে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। 

বিশেষজ্ঞ দের মতামত অনুসারে, অনিয়ন্ত্রণিত জীবনযাপন করার কারণেই মূলত আমাদের ব্লাড সুগার বেড়ে যেতে পারে। আমাদের সমাজে বহু মানুষ এমন আছেন যারা স্বাভাবিক ব্লাড সুগার লেভেল এবং সুগার নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতি গুলো সম্পর্কে ঠিক মত জানেন না ,এতে করে তাদের রক্তে সুগারের মাত্রার পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। 

আর এর প্রভাব যদি আপনার শরীরে বেড়ে যায় তাহলে এটি আপনার মৃত্যুর কারণ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়াতে পারে। এজন্য রক্তে সুগারের মাত্রা বা Blood Sugar Level নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে আমাদের বিস্তারিত ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি।

 

ব্লাড সুগার (Blood Sugar) কী ?

রক্তে গ্লুকোজ বা সুগারকে  আমরা অনেক সময় গ্লাইসেমিয়া (Glycaemia) বলে থাকি। গ্লাইসেমিয়া হল আমাদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বা রক্তে শর্করার ঘনত্ব। 

আমরা যে সমস্ত খাবার খাই তার মাধ্যমে গ্লুকোজ আমাদের রক্তে প্রবেশ করে এবং  আমাদেরকে কাজ করার শক্তি প্রদান করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, একজন ৭০ কেজি মানুষের শরীরে গ্রাম গ্লুকোজ সব সময় উপস্থিত থাকে।

আরও পড়ুন....

অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস হলে আপনার শরীরের যে সব অঙ্গ-প্রতঙ্গের ক্ষতি হতে পারে ?

 ব্লাড সুগার লেভেল (Blood Sugar Level) কয় ধরনের ?

একজন মানুষের শরীরে সাধারণত তিন ধরণের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা  বা Blood Sugar Level দেখা দিতে পারে। সেগুলো হল

ব্লাড সুগার লেভেল  কয় ধরনের ?
ছবি:সংগৃহিত

  • Normal Blood Sugar (স্বাভাবিক ব্লাড সুগার)
  • High Blood Sugar (হাই ব্লাড সুগার) 
  • Low Blood Sugar (লো ব্লাড সুগার)

Normal Blood Sugar :

What’s normal blood sugar ?

বিশেষজ্ঞ দের মতে, নরমাল ব্লাড সুগার বা স্বাভাবিক রক্তে সুগারের মাত্রার আদর্শ মান হল দশমিক শতাংশ। 

রক্তে সুগারের মাত্রা এর চেয়ে বাড়লে বা কমলে আপনার শরীরে হাইপারগ্লাইসেমিয়া বা হাইপোগ্লাইসেমিয়া দেখা দিতে পারে।

High Blood Sugar :

হাই ব্লাড সুগারকে সাধারণত চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় আমরা হাইপারগ্লাইসেমিয়া  (Hyperglycemia) বলে থাকি। হাইপারগ্লাইসেমিয়া হলে আপনার রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বেড়ে যেতে পারে। 

অর্থাৎ আপনার রক্তে শর্করার পরিমাণ যদি ২০০ মিলিগ্রামের চেয়ে বেশি হয়ে যায় তাহলে আপনার হাই ব্লাড সুগার বা হাইপারগ্লাইসেমিয়া (Hypoglycemia )হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।

Low Blood Sugar :

লো ব্লাড সুগারের আরেক নাম হল হাইপোগ্লাইসেমিয়া (Hypoglycemia) আপনার রক্তে শর্করা বা চিনির পরিমাণ যদি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কমে যায় তাহলে তাকে লো ব্লাড সুগার বা হাইপোগ্লাইসেমিয়া বলে। 

হাইপোগ্লাইসেমিয়া হলে আপনার রক্তে সুগারের মাত্রা প্রতি লিটারে ৭০ মিলিগ্রামের চেয়েও অনেক কমে যেতে পারে।

রক্তের সুগারের লেভেল বেড়ে গেলে যেসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে

রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা   বেড়ে গেলে আপনার শরীরে নিম্নোক্ত লক্ষণ গুলো দেখা দিতে পারে। এর ফলে বুঝতে পারবেন আপনার ব্লাড সুগার লেভেল হাই কি না লক্ষণ গুলো সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হল

বার বার পানির তেষ্টা পাওয়া :

আপনার যদি রক্তের মধ্যে গ্লুকোজ বা সুগারের পরিমান বেড়ে যায় তাহলে এর প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে আপনার বার বার পানির পিপাসা পেতে পারে। অর্থাৎ সময় আপনার ডিহাইড্রশনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। সাধারণত প্রস্রাবের মধ্য দিয়ে সুগার বের হয়ে যাওয়ার কারণে আপনার শরীর শুষ্ক হয়ে যেতে পারে। এজন্য বার বার পানির পিপাসা পেতে পারে।

ক্ষুধার ইচ্ছা বেড়ে যাওয়া :

বার বার ক্ষুধা লাগা ব্লাড সুগার লেভেল  বেড়ে যাওয়ার একটি অন্যতম লক্ষণ। রক্তের মধ্যে গ্লুকোজ বা সুগারের পরিমান বেড়ে গেলে প্রস্রাব বেশি হওয়ার কারণে আপনার শরীর থেকে দ্রুত ক্যালোরি বেড়িয়ে যেতে থাকে। এর ফলে ক্ষুধা লাগার প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে।  সময় আপনার খাবার খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার খিদে পেতে পারে।

ওজন হ্রাস পাওয়া :

Blood Sugar Level বেড়ে যাওয়ার কারণে আপনার তেষ্টা এবং প্রস্রাবের পরিমান অনেক বেশি বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে আপনার শরীর থেকে ক্যালোরি বেড়িয়ে যেতে শুরু করে। যা ধীরে ধীরে আপনার শরীরের ওজনকে কমিয়ে দিতে পারে।

ঘন ঘন প্রস্রাব আসা :

রক্তের মধ্যে সুগারের পরিমান বেড়ে যাওয়ার কারণে আপনার শরীর অনেক শুষ্ক হয়ে যেতে পারে। এর ফলে আপনার বার বার পানির পিপাসা পেতে থাকে। আর পানি বেশি পরিমানে খাওয়ার কারণে আপনার কিডনির উপর চাপ পড়তে পারে। জন্য ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাওয়া :

রক্তে সুগার বেড়ে গেলে আপনার দৃষ্টিশক্তির উপর প্রভাব ফেলতে পারে। এর ফলে দৃষ্টিশক্তি কমতে শুরু করে। যার ফলে আপনি অনেক সময় সামনের বস্তুকে ঝাপসা দেখতে পারেন।

 অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভব করা :

রক্তে সুগারের পরিমাণ বেড়ে গেলে আপনার শরীর থেকে তরল জাতীয় পদার্থ বের হয়ে যেতে থাকে। এর ফলে আপনার শরীর অনেক দূর্বল হয়ে পড়তে পারে এবং সময় আপনার অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভূত হতে পারে।

শরীরে অসাড়তা দেখা দেওয়া :

আপনার রক্তের মধ্যে সুগারের পরিমান যদি অত্যধিক ভাবে বেড়ে যায় তাহলে তা নার্ভের বা স্নায়ুর ক্ষতি করতে পারে। যার ফলে আপনার হাত, পা সহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে অসাড়তা দেখা দিতে পারে।

ত্বকের সমস্যা দেখা দেওয়া :

আপনার শরীরে সুগারের পরিমান বেড়ে যাওয়ার ফলে ত্বকের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। রক্তে সুগারের পরিমান বেড়ে গেলে আপনার ত্বক অনেক বেশি রুক্ষ হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় চুলকানির সমস্যাও সৃষ্টি হতে পারে।

 

ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায়

ব্লাড সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আপনাকে নিম্নোক্ত পদ্ধতি গুলো অবলম্বন করতে হবে তাহলে ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখা আপনার জন্য অনেক সহজ হয়ে যাবে। পদ্ধতি গুলো হল

জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন করা :

আপনাকে  Blood Sugar Level নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সবার প্রথমেই জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন করা দরকার। 

অতিরিক্ত আধুনিক জীবনযাপনের পথে না চলে বা সব সময় ডিজিটাল ডিভাইসের উপর নির্ভর না করে নিজেকে সক্রিয় রাখার চেষ্টা করতে হবে। এর ফলে আপনার কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে রক্তে সুগারের পরিমাণ স্বাভাবিক থাকবে।

 

টেনশন বা দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা :

রক্তে শর্করা বা গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে আপনাকে অব্যশই টেনশন বা দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে হবে। 

যে কোন বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত টেনশন বা দুশ্চিন্তা করা বাদ দিতে হবে তাহলে আপনার মানসিক চাপ বা অবসাদ তুলনামূলক ভাবে অনেক কম হবে। এর ফলে আপনার রক্তে সুগারের পরিমাণ স্বাভাবিক থাকবে বলে আশা করা যায়।

নিয়মিত হাঁটা বা শরীরচর্চা করা :

নিয়মিত যদি আপনি শরীরচর্চা এবং ব্যায়াম করেন তাহলে আপনার শরীর থেকে অতিরিক্ত গ্লুকোজ বা চিনি ঘামের মাধ্যমে বেড়িয়ে যাবে। নিয়মিত ব্যায়াম করার ফলে আপনার রক্তে সুগারের মাত্রা স্বাভাবিক থাকবে  

এর ফলে আপনার কাজ করার শক্তি আরও বেড়ে যাবে এবং দৈনন্দিন কাজে ব্যাঘাত ঘটতে পারবে না। তাই রক্তে সুগার পরিমাণ স্বাভাবিক রাখার জন্য প্রতিদিন অন্তত আপনার ৩০ মিনিট হাঁটা অথবা শারীরিক ব্যায়াম করা উচিত।

মিষ্টি জাতীয় খাবার পরিহার করা :

রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আপনাকে মিষ্টি জাতীয় খাবার পরিমাণে খুব কম খেতে হবে। কারণ এসব খাবারে প্রচুর পরিমাণ শর্করা চিনি থাকে। 

এই শর্করা চিনি জাতীয় খাবার রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে যার থেকে আপনার পরবর্তীতে ডায়াবেটিস হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে।

অ্যালকোহল যুক্ত খাবার ত্যাগ করা :

আপনাকে ব্লাড সুগার(Blood Sugar Level)নিয়ন্ত্রণেরাখতে হলে অতিরিক্ত অ্যালকোহল জাতীয় খাবার যেমন কোল ড্রিংকস, মদ প্রভৃতি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে কারণ এসব পানীয় বা অ্যালকোহল জাতীয় খাবারের মধ্যে উচ্চ মাত্রার গ্লুকোজ মিশানো থাকে আর এগুলো সরাসরি আপনার রক্তে পৌছে গিয়ে ইনসুলিন মাত্রা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। 

পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রাম নেয়া :

আপনি নিয়মিত যদি পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রাম নেন তাহলে আপনার মানসিক চাপ ক্লান্তি অনেক কম যাবে। এর ফলে আপনার রক্তে সুগারের মাত্রা স্বাভাবিক থাকবে। 

যার ফলে আপনার হাইপারগ্লাইসেমিয়া হওয়ার আশঙ্কা কমে যাবে। জন্য রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে আপনাকে অবশ্যই ঘুম বিশ্রাম ঠিকমত নিতে হবে।  

 

সঠিক খাবার গ্রহণ করা :

আপনার রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিক রাখার জন্য এবং হাই ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আপনাকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী একটি সঠিক খাদ্য তালিকা অনুসরণ করতে হবে।

সেই সাথে আপনার খাদ্য তালিকায় বার্লি, বাদাম, ভুট্টা, মেথির বীজ, ওটমিল, ব্রাউন রাইস, সবুজ শাক-সবজী, বাজরা ইত্যাদি শস্য জাতীয় খাদ্য খাবারের তালিকায় রাখতে পারেন শস্য জাতীয় খবারে আঁশ থাকে যা আপনার সুগারের মাত্রা কমাতে সহায়তা করে সেজন্য আপনাকে বেশি বেশি করে এসব খাবার খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে।

 উচ্চ রক্তচাপ বা(Hypertension)কি ? কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন?

উপসংহার  

রক্তে সুগার বা ব্লাড সুগারকে (Blood Sugar Level) চিকিৎসকরা অনেক সময় নীরব ঘাতক নামে অ্যাখায়িত করে থাকেন কারণ কোন লক্ষণ প্রকাশ না পাওয়া সত্ত্বে এটি আপনার শরীরের অভ্যন্তরে মারাত্নক ভাবে ক্ষতি করতে পারে। অতএব আপনার যদি রক্তে গ্লুকোজ বা ব্লাড সুগারের আধিক্য থাকে তাহলে অবশ্যই সেটিকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। 

তা না হলে আপনার শরীরে এর প্রভাব বেড়ে গেলে পরবর্তীতে এর থেকে আপনার শরীরে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে যা আপনার সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপনের পথে মারাত্মক বাঁধার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। 

তাই আপনি যদি ব্লাড সুগার(Blood Sugar Level) বা রক্তে শর্করার আধিক্য হওয়ার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে চান তাহলে অবশ্যই আপনাকে উপরিউক্ত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে এবং অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। 

 

Post a Comment

Previous Next