নিউমোনিয়া কি ? নিউমোনিয়া হওয়ার কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত
কি কারণে আপনার Pneumonia হতে পারে ? আপনার নিউমোনিয়া হয়েছে কি না ? সে সম্পর্কে নিশ্চিত হবেন কিভাবে ? কিভাবে এই রোগ থেকে বাঁচতে পারবেন ? এ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন –
নিউমোনিয়া আসলে কি ?
এটি হল আমাদের ফুসফুস বা শ্বাসনালীর একটি
প্রদাহ জনিত সংক্রমক রোগ। এ রোগের ক্ষেত্রে প্রথমে আমাদের ফুসফুসে জীবাণুর সংক্রমণ ঘটে এবং পরবর্তীতে
এর থেকে শ্বাসনালীতে প্রদাহ
বা ব্যথা হয়।
অন্যভাবে
ও আমরা বলতে পারি
যে , আমাদের ফুসফুস বা শ্বাসনালীর ভিতরে
যখন ভাইরাস, ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া প্রভৃতির সংক্রমণ ঘটে এবং পরবর্তীতে
এই সংক্রমণ থেকে প্রদাহ জনিত
অবস্থার সৃষ্টি হয় তখন ঐ
অবস্থাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় নিউমোনিয়া।
নিউমোনিয়া কাদের বেশি হয় ?
এ রোগ আমাদের সবারই হতে পারে এবং এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার কোন নির্দিষ্ট বয়সসীমা থাকে না তার মানে হল যে কোন বয়সেই আপনার হতে পারে। তবে শিশু এবং বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে এবং সেই সাথে মৃত্যুর হার ও মধ্যবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের অনেক বেশি এমনটি গবেষণায় দেখা গেছে। Pneumonia বছরের যে কোন সময়েই হতে পারে তবে শীত কালে আক্রান্তের হার ও মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি থাকে। তাই এ সময় নিজের শরীরের প্রতি আমাদেরকে বিশেষ ভাবে সর্তক থাকতে হবে।
নিউমোনিয়া কয় ধরনের হয়ে থাকে ?
সাধারণত
একজন মানুষের ফুসফুস বা শ্বাসনালীতে বিভিন্ন
ধরনের নিউমোনিয়া দেখা দিতে পারে।
সে গুলো হল –
* Bacteria (ব্যাকটেরিয়া নিউমোনিয়া)
* Viral (ভাইরাল নিউমোনিয়া)
* Mycoplasma (মাইকোপ্লাজমা
নিউমোনিয়া)
* Pneumocystis
Jiroveci (নিউমোসিস্টিস
জিরোভেসি নিউমোনিয়া)
* Community Acquired (পারস্পরিক সংস্পর্শ থেকে হওয়া নিউমোনিয়া)
* Hospital Acquired (হাসপাতাল থেকে হওয়া নিউমোনিয়া)
* Aspiration (অ্যাসপিরেশন
নিউমোনিয়া)
* Ventilator
Associated (ভেন্টিলেটর
সংশ্লিষ্ট নিউমোনিয়া)
উপরিউক্ত
নিউমোনিয়া গুলোর ভিতর থেকে বর্তমানে
Bacteria Pneumonia (ব্যাকটেরিয়া
নিউমোনিয়া) ভয়াবহভাবে বিস্তার লাভ করছে যা
বাইরের ধুলো-বালি, কলকারখানা
ও যানবাহনের কালো ধোঁয়া প্রভৃতির
মাধ্যমে আমাদের শ্বাসনালী বা ফুসফুসের ভিতরে
প্রবেশ করে এবং ধীরে
ধীরে আমাদের শ্বাসনালীর মারাত্নক ক্ষতি করতে পারে।
কী কী কারণে আপনার নিউমোনিয়া হতে পারে ?
ধুলা-বালি থেকে :
বাইরের
ধুলা-বালি যদি নাক-মুখের মাধ্যমে আপনার ফুসফুসের ভিতরে প্রবেশ করলে তাহলে এই
ধুলা-বালি থেকে সৃষ্ট
জীবাণু আপনার ফুসফুস বা শ্বাসনালিতে প্রদাহ
সৃষ্টি করে যার দরুন
আপনার নিউমোনিয়া হতে পারে।
আবহাওয়ার
পরিবর্তন হলে :
আবহাওয়া
পরিবর্তন অর্থাৎ অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডা
আবহাওয়ার কারণে ও আপনার নিউমোনিয়া
হতে পারে। তবে সাধারণত শীত
কালে অতিরিক্ত ঠান্ডায় এই রোগ বেশি
হতে দেখা যায়।
ধূমপান
করলে :
ধূমপান করার ফলে সিগারেটের ভিতরে থাকা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের কারণে আপনার শ্বাসনালী টক্সিক বা বিষাক্ত হয়ে উঠতে পারে এবং শ্বাসনালীতে প্রদাহ বা ব্যাথা হতে পারে। যার ফলে আপনার এ রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
অ্যালকোহল
জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করলে :
আপনি
যদি মদ বা অ্যালকোহল
জাতীয় দ্রব্য বেশি খান তাহলে
এর ভিতরে থাকা উচ্চ মাত্রার
অ্যালকোহল আপনার ফুসফুস বা শ্বাসনালীতে প্রশ্বাস-নিঃশ্বাসের স্বাভাবিক গতিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। এর ফলে আপনার Pneumonia
হতে পারে।
সংক্রমিত
ব্যক্তির সংস্পর্শে থাকলে :
আপনি যদি সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে থাকেন এবং তার ব্যবহৃত জিনিস যেমন : টুথব্রাশ, টাওয়াল প্রভৃতি ব্যবহার করেন তাহলে এসব জিনিস থেকে আপনার ফুসফুসে জীবাণু প্রবেশ করতে পারে। এর ফলে আপনার নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
সংক্রমিত
ব্যক্তির হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ও আপনার ফুসফুসে
জীবাণু সংক্রমিত হতে পারে এর
ফলে আপনার নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।
রোগ
প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে :
আপনার
শরীরের ইমিউনো সিস্টেম যদি দূর্বল থাকে
বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
কমে যাওয়ার কারণে জীবাণু সহজেই আপনার ফুসফুসকে আক্রমণ করতে পারে। এর
ফলে আপনার
নিউমোনিয়া হতে পারে।
জটিল
রোগে ভুগলে :
দীর্ঘদিন ধরে যদি আপনি জটিল কোন রোগ যেমন ফুসফুস জনিত রোগ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ প্রভৃতিতে ভুগে থাকেন তাহলে আপনার ফুসফুসে নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।
নিউমোনিয়া শরীরে কোন ধরনের লক্ষণ দেখা যেতে পারে ?
নিঃশ্বাস
নিতে সমস্যা হওয়া :
নিউমোনিয়া প্রভাব বেড়ে গেলে আপনার শ্বাসনালীতে ঠিকমত বাতাসের আদান-প্রদান না থাকার কারণে এ সময় নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
বুকে
নিচের অংশ ভিতরে ঢুকে
যাওয়া :
আপনার
মারাত্মক নিউমোনিয়া হলে শ্বাস নেওয়ার
সময় বুকের নিচের অংশ ভিতরে ঢুকে
যেতে পারে।
অতিরিক্ত
কাশি হওয়া :
নিউমোনিয়া হওয়ার আগে আপনার হালকা কাশি হতে পারে। ধীরে ধীরে যদি আপনার কাশির গতি বাড়তে থাকে এ সময় আপনার শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
আপনার ফুসফুসে নিউমোনিয়ার প্রভাব মারাত্মক ভাবে বেড়ে গেলে শ্বাসকষ্টের সাথে আপনার শরীরে খিঁচুনি ও দেখা দিতে পারে।
অতিরিক্ত
ক্লান্তি অনুভব করা :
ফুসফুসে
নিউমোনিয়া আক্রমণ করলে অতিরিক্ত জ্বর,
বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট প্রভৃতির কারণে আপনার শরীর অনেক দূর্বল
হয়ে পড়তে পারে এবং
এ সময় আপনার অতিরিক্ত
ক্লান্তি অনুভূত হতে পারে।
দম বন্ধ হয়ে যাওয়া
:
নিউমোনিয়ার
প্রভাব যদি বেড়ে যায়
তাহলে আপনার দম বা শ্বাস
বন্ধ বন্ধ ভাব
দেখা দিতে পারে।
বমি
বমি ভাব :
আপনার ফুসফুসের ভিতরে নিউমোনিয়া প্রভাব মারাত্মক ভাবে বেড়ে গেলে আপনার বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে।
নিউমোনিয়া হলে কোন ধরনের পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হয় ?
আপনার ফুসফুসের উপর নিউমোনিয়ার প্রভাব ও ধরণ অনুযায়ী চিকিৎসক নিম্ন লিখিত পরীক্ষা-নীরিক্ষা গুলো করে থাকেন। পরীক্ষা-নীরিক্ষা গুলো হল –
* Physical Test (শারীরিক পরীক্ষা)
* Blood Test (রক্ত পরীক্ষা)
* Mucus Test (কফ বা শ্লেষা
পরীক্ষা)
* X-ray (এক্স-রে)
উপরিউক্ত
পরীক্ষা-নীরিক্ষাগুলো করার আগে অবশ্যই
আপনাকে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
আপনার Pneumonia হলে কী উপায়ে প্রতিকার করবেন ?
নিউমোনিয়া হলে সর্বপ্রথমেই আপনাকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এরপর চিকিৎসক আপনার শরীরে এর প্রভাবের উপর ভিত্তি করে প্রয়োজন বোধে নিচের পদ্ধতিতে চিকিৎসা করে থাকেন। পদ্ধতি গুলো হল –
এন্টিবায়োটিক
ওষুধ সেবন :
আপনার
শরীরে নিউমোনিয়ার প্রভাব অল্প থাকলে চিকিৎসকের
পরামর্শ নিয়ে আপনি এন্টিবায়োটিক
জাতীয় ওষুধ খেতে পারেন।
এসব ওষুধ: সিরাপ, ক্যাপসুল, ড্রপ, ট্যাবলেট প্রভৃতি আকারে ফার্মেসীতে পাওয়া যায়। তবে ওষুধ
সেবনের আগে কোন ওষুধ
আপনার জন্য প্রযোজ্য তা
জানতে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন।
শ্বাস-প্রশ্বাসের থেরাপি :
যখন আপনার নিউমোনিয়ার মাত্রা খুব বেশি হয় তখন এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হয়। এই থেরাপির মাধ্যমে আপনার শ্বাস-প্রশ্বাসে অক্সিজেনশনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে।
অক্সিজেন
থেরাপি :
নিউমোনিয়ার প্রভাব বেশি হলে চিকিৎসক এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা দিতে পারেন। এর ফলে আপনার রক্তে অক্সিজেন স্তর বজায় থাকবে।
কীভাবে
আপনার নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করবেন ?
নিউমোনিয়ার থেকে বাঁচতে হলে আপনাকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগ দিতে হবে এবং সেগুলো ঠিক মত পালন করতে হবে। বিষয়গুলো হল –
জীবনযাত্রার
পরিবর্তন করা :
আপনাকে Pneumoniaপ্রতিরোধ করার জন্য সবার আগেই জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন করা দরকার। রোগ-ব্যাথি সম্পর্কে সব সময় সচেতন থাকতে হবে। অসুখ-বিসুখ দেখা দেয়ার সাথে সাথে হেলা-ফেলা না করে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
পরিষ্কার-পরিছন্ন থাকা :
নিউমোনিয়ার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হলে আপনাকে সব সময় পরিষ্কার-পরিছন্ন থাকতে হবে। বাইরের ধুলা-বালি এড়ানোর জন্য মুখে মাস্ক পড়তে হবে এবং বাড়িতে ফিরে গোসল করতে হবে। এতে করে বাইরের জীবাণু আপনার শরীরে সহজে প্রবেশ করতে পারবে না।
ধূমপান
এবং মদ্যপান ত্যাগ করা :
নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করতে হলে সবার প্রথমেই আপনাকে ধূমপান এবং মদ্যপান করা বন্ধ করে দিতে হবে। এর ফলে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থগুলো আপনার শ্বাসনালীর ভিতরে প্রবেশ করতে পারবে না এর ফলে প্রদাহ হবে না এবং প্রশ্বাস-নিঃশ্বাসের প্রক্রিয়া ও স্বাভাবিক থাকবে।
পর্যাপ্ত
ঘুম এবং বিশ্রাম নেয়া
:
আপনি নিয়মিত যদি পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রাম নেন তাহলে আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এবং ফুসফুসে জীবাণু সহজে আক্রমণ করতে পারবে না যার ফলে আপনার নিউমোনিয়া হওয়ার আশঙ্কা কম থাকবে। এ জন্য নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করতে হলে আপনাকে অবশ্যই ঘুম ও বিশ্রাম ঠিকমত নিতে হবে।
সুষম
খাবার গ্রহণ করা :
আপনার ফুসফুসকে ভাল রাখার জন্য এবং Pneumoniaপ্রতিরোধ করতে হলে সুষম খাবার গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। আপনি যদি সুষম খাবার খাবার যেমন : আঁশজাতীয় খাবার, তাজা ফলমূল, বীজ জাতীয় খাবার, সবুজ শাক-সবজি, প্রয়োজনীয় আমিষ ইত্যাদি বেশি করে খান তাহলে আপনার শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিনের চাহিদা পূরণ হবে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
থাইরয়েড ক্যান্সার (Thyroid Cancer) কী ? থাইরয়েড ক্যান্সার হলে শরীরে কি কি লক্ষণ দেখা দিতে পারে ?
উপসংহার,
নিউমোনিয়ার প্রভাব যদি আমাদের শ্বাসনালীতে বেড়ে যায় তাহলে এটি আমাদের সুস্থভাবে জীবনযাপনের পথে একটি মারাত্নক বাঁধার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই এই রোগের লক্ষ্মণ গুলো সম্পর্কে আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে এবং এর লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে। কারণ প্রাথমিক অবস্থায় এই রোগের চিকিৎসা করালে আপনি দ্রুতই এই রোগ থেকে সেরে উঠে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন। তাই আপনি যদি নিউমোনিয়ার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চান তাহলে অবশ্যই আপনাকে Pneumoniaপ্রতিরোধী কাজ করতে হবে আর সেই সাথে উপরিউক্ত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে এবং অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।